Atheist Chapter
মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায় ও অন্যান্য হত্যাকান্ডের বিচার

মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায় ও অন্যান্য হত্যাকান্ডের বিচার

প্রগতিশীলতা শুধু ঘরের চৌকাঠের বাইরের জিনিস নয়, নিজের ঘরের ভিতরেও এর চর্চা করতে হয়। এ রকম একটি ভিন্নমত থেকেই ২০০৮ সালের প্রথম দিকে অভিজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত “মুক্তমনা” থেকে আমি অনিয়মিত হয়ে যাই। যদিও আমার এ যুক্তির পক্ষে অভিজিতের জোরালো সমর্থণ ছিল না প্রথম দিকে।

বিষয়টির সূত্রপাত “মুক্তমনা”-র তখনকার এক উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যকে নিয়ে। আমি সে ভদ্রলোকের অনেকগুলো লেখা অভিজিতকে পাঠিয়ে বলেছিলাম,এ ভদ্রলোক কিভাবে “মুক্তমনা”র উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য হোন? কেননা, লেখায় ভিন্নমতের স্বাধীনতা যে কারো আছে এবং থাকাই স্বাভাবিক; কিন্তু “মুক্তমনা” যখন একটি বিশেষ আদর্শকে ধারণ করে, তাই সে আদর্শের যে প্লাটফরম তাঁর সংগঠকদের মধ্যে এ ধরণের ধোঁয়াশে চরিত্রের মানুষের নাম থাকা যথোচিত নয়। আমার যুক্তিটি অভিজিতের পছন্দ হয়নি তখন, আমিও সরে এসেছিলাম আর কোনরূপ কথা না বাড়িয়ে। আমার আগে ও পরে অনেকেই “মুক্তমনা”য় নিস্ক্রিয় হয়েছিলেন এ রকম অনেক ভিন্নমত ও আদর্শিক দ্বন্দ্বে। কিন্তু মুক্তমনার সাথে আত্মিক সম্পর্কচ্ছেদ হয়নি এক মুহুর্তের জন্যও; পারস্পারিক ভাললাগার ব্যতয় ঘটেনি আমাদের কখনোই।

বেশ কিছু পরে অভিজিৎ সে ভদ্রলোকের নাম “মুক্তমনা” থেকে সরিয়েই শুধু দেননি, তাঁকে নিজের ফেইসবুকেও ব্লক করেছিলেন বলে জেনেছি। যদিও ফেইসবুকের বন্ধু তালিকায় কে কা’কে রাখবেন সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়; কিন্তু এখনো বিশ্বাস করি “মুক্তমনা”র মতো সাইটের সংগঠকদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে অস্বচ্ছ ( ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত) ধারণার মানুষদের না রাখাই যথার্থ হয়েছে।

এর পরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অভিজিতের আরেকটি লেখায় কিছু শব্দ প্রয়োগ নিয়ে আমাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ মতান্তর ঘটেছিল। সে সময়ে স্বীকার না করলেও পরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অন্যান্য লেখায় অভিজিৎ একটু সাবধানী হয়েছিলেন ব’লেও আমার মনে হয়েছে। কেননা, আমি বিশ্বাস করি দু’একটি প্রবন্ধ কিংবা বই পড়ে রবীন্দ্রনাথের মতো এত বিশাল প্রতিভাকে নিয়ে বিপরীত স্রোতে কলম ধরা একধরণের বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। আমরা অনেকেই সে সময় এ কথাই বলতে চেষ্টা করেছিলাম যে, ভবিষ্যতে এ ধরণের লেখার জন্য তাঁকে অনুতাপ কিংবা অনুশোচনা করতে হ’তে পারে। অভিজিৎ আমাদের অনেকের ধারণাকেই ভুল প্রমান করে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের উপর গবেষনামূলক একটি বিশাল বই লিখে ফেলেছেন এবারের বই মেলায়। বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে লেখায় যিনি সিদ্ধহস্ত তাঁর কাছে সাহিত্য বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মতো বহুগবেষিত লেখকের বিষয় নিয়ে লেখা বইটি না পড়লেও, বইটির সমালোচনা পড়ে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি।

সাহিত্য নিয়ে উৎকর্ষ লেখা লিখলেও অভিজিতের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য ছিল বিজ্ঞান-দর্শণ-ধর্মসহ সাধারণের বোধের বাইরের জটিলতম বিষয়গুলোকে সহজ ও সাবলিল ভাষায় যুক্তিগ্রাহ্য করে উপস্থাপনের চেষ্টা। সেই সাথে বিজ্ঞান ও দর্শণের নানা বিষয়কে আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরে এর ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে পাঠকের মনঃসংযোগ ঘটানো। অভিজিতের লেখার প্রধান শক্তি এই যে, এতে একদিকে যেমন মনে এক দ্বন্দ্বমূলক ভাবের অবতারণা হয়, অন্যদিকে ভাবনার মূলে সংশয় ও জিজ্ঞাসা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে অন্ধবিশ্বাসের।

কিন্তু অভিজিতের লেখার পাঠককেও পাঠপূর্ব অনুশীলনের দরকার পড়ে, প্রয়োজন হয় একধরণের পাঠ্যাভাসেরও। অভিজিৎ রায়ের লেখা না পড়ে যতটা বিপক্ষে মন্তব্য করা যায় কিন্তু পড়লে সেটা হয়ত সম্ভব নয়। তাই যে মৌ্লবাদী ধর্মান্ধরা অভিজিতকে হত্যা করেছে তারা কেউই অভিজিতের লেখা পড়েছে ব’লে আমি মনে করি না। বরং এক ধরণের ধর্মীয় উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক জোস থেকেই অভিজিৎ হত্যাকান্ড। তার প্রধান কারণ হয়ত “মুক্তমনা” এবং “মুক্তমনা”-য় লেখা অসংখ্য মুক্তচিন্তার রচনা, যা অনেক মানুষকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে, আলোকিত করতে সহায়ক হয়েছে। ঘাতকেরা জানতো এসবের পেছনের মানুষটি অভিজিৎ রায়। তাই সুযোগ বুঝেই অভিজিতকে সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে।

অভিজিতের লেখাগুলো ব্লগ কিংবা অনলাইন মাধ্যমের বাইরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে বলে মনে হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের কাছে অভিজিৎ রায়ের কোন বিশেষ লেখা ব্যাপক আলোড়ণ কিংবা আলোচনা হয়েছে বলেও শোনা যায়নি; যা হয়েছিল অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বেলায়। হুমায়ুন আজাদের “পাক সার জমিন সাদ বাদ” প্রকাশের সাথে সাথেই দেশব্যাপী ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের প্রতিবাদ লক্ষিত হয়েছিল, যা অভিজিতের কোন বিশেষ লেখার ব্যাপারে শোনা যায়নি। কিন্তু তবে প্রশ্ন, অভিজিৎ কেন ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের টার্গেট হলেন?

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অভিজিতকে হত্যার টার্গেট করতে তাঁকে “নাস্তিক” হিসেবে প্রচার করাই বাংলাদেশের মতো হুজুগেচলা পাবলিকের দেশে যথেষ্ঠ। বাংলাদেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এমন আকার ধারণ করেছে যে, এখন যে কাউকে ইসলামবিরোধী ব’লে মোটামুটি প্রচার করে দিলেই হলো। সেই সাথে যদি দেখানো যায় যে তথাকথিত ধর্মবিদ্বেষী ব্যক্তির নাম জন্মসূত্রে অন্যধর্ম সাদৃশ্য এবং তিনি নাস্তিক, তবে তো সোনায় সোহাগা। নাস্তিকতা কী এবং কেন, খায় না পিন্দে এসবের ণত্ব-ষত্ব জানার দরকার নেই, সব কিছু না-জেনে না-পড়ে শুধু নাস্তিক একথার ভিত্তিতেই তাঁকে মারার জন্য সাচ্চা ঈমানদার মানুষের অভাব হবে ব’লে মনে হয় না। শুধু হত্যা নয়, হত্যা পরবর্তি কোনো জনমত কিংবা আইনীসহায়তা পাওয়াও হবে প্রচন্ড দুরূহ, যা ইদানিং পরিলক্ষিত হচ্ছে অভিজিতের ব্যাপারেও।

স্মৃতি প্রতারিত না করলে মনে পড়ছে, ১/১১ –এর পরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বন্দি, তখন তাঁর স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে এক ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন। রাজনীতিবিদ তো দুরের কথা অনেক সুশীলকেও তখন দেখা যায়নি অসুস্থ ডঃ ওয়াজেদ মিয়াকে দেখতে যেতে। তখন যিনি অনেকবার তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে নিজের ছাত্র বলে পরিচয় দিয়ে গর্বিত হয়েছিলেন তিনি প্রথিতযশা শিক্ষক শুধু নন, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন এক নিপাট ভদ্রলো্‌ক, মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায়,অভিজিতের গর্বিত পিতা।

অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি একটিবারের জন্য পুত্রশোকাহত অধ্যাপক অজয় রায়কে সমবেদনা জানাতে গিয়েছেন কিংবা তাগিদ অনুভব করেছেন? হয়ত ক’রে থাকতে পারেন কিন্তু যেতে পারেননি কিংবা যাননি একমাত্র কারণে; আমার মনে হয় সেটা আর কিছু নয়, তাঁর ভোটহারানোর ভয়।কেননা, আমাদের মিডিয়াগুলো ইতিমধ্যেই মৃত অভিজিতের গায়ে ইসলামবিরোধী তকমা লাগিয়ে দিয়ে আমজনতার তথাকথিত ধর্মানুভূতিতে সুড়সুড়ি তুলে দিয়েছে।

তাই জীবিত অভিজিত রায় ধর্মান্ধ মৌ্লবাদীদের কাছে যেমন ভয়াবহ ছিলেন, মৃত অভিজিৎ রায় তেমনি প্রগতিশীলতার ভেকধারী মানুষ এবং আমজনতার ভোটপ্রত্যাশী নষ্ট রাজনীতিবিদদের কাছে তেমনি অচ্ছুৎ ও সহানুভূতিহীন। তা না হ’লে অভিজিতের হত্যাকান্ডের পর সুশীল সমাজ ও প্রগতিশীল মানুষদের গা-ছাড়া ভাব কেন? কিন্তু এ সবে কি শেষরক্ষা হবে? আমি তা মনে করি না।

এক হুমায়ুন আজাদ নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমান করে গেছেন, দেশ নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে। এক দশক পর অভিজিৎ রায়ও প্রাণ দিয়ে প্রমান করে গেলেন, সে নষ্টদের অধিকারের আগ্রাসন আরও ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ আপোষ দিয়ে হবে না। ধর্মান্ধতার উগ্রতাকে উৎপাটন করতে হবে সমূলে, অন্যথায় কারও নিস্কৃতি নেই। মুক্তবুদ্ধি দূরে থাক,স্বাভাবিক সভ্যভব্য-বিশ্বাসী-নিরীহ-নিপাট জীবনযাত্রাও কি সম্ভব হবে এই ধর্মান্ধদের স্বপ্নদেখা দেশে? মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রোএশিয়ার অনেক দেশের মতোই কি হবে না বাংলাদেশের অবস্থা?

তাই অভিজিতের রেখে যাওয়া পরিবার -পরিজনের জন্য শুধু নয়, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে টিকিয়ে রাখতেও হুমায়ুন আজাদ, রাজিব-জগৎজ্যোতি, অভিজিৎ রায়সহ প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ জংগীগোষ্ঠী দ্বারা নিহত সবার বিচার শুরু করতে হবে এখনই, কালবিলম্ব না ক’রে এখনই।

। মার্চ ৫, ২০১৫।

Saiful Islam

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.

Most popular