Atheist Chapter
চিরঞ্জীবি অভিমন্যু

চিরঞ্জীবি অভিমন্যু

যা নেশা তাই অনেক সময় পেশা হয়ে যায়। এমন হলে সোনায় সোহাগা। কারন এমন হলে পেটের দায়ে ইচ্ছের বিপরীতে হাটা লাগে না- জোর করে গেলা লাগে না কুইনিন। ঠিক একই ভাবে বলা যায়, যে সন্তান পিতার ভাব-চিন্তা ধারন করে পিতার থেকে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় সে একই সাথে ভাব-সন্তান ও জৈবনিক সন্তান। অভিজিত রায় অজয় রায়ের তেমনই এক সন্তান, যার নেশা ও পেশার এক ব্যতিক্রমী সমন্বয় ঘটেছিল বিজ্ঞানে। যেমন ঘটেছিল লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির বেলায়, ঘটেছিল বিশ্বনাট্যকার শেক্সপেয়ারের বেলায়ও। এমন সমন্বয় থেকে পৃথিবী অনেক কিছু পায়। অভিজিতের কাছ থেকে বাংলাদেশ যা কিছু পেয়েছিল তা যথেষ্ট নয়, আরো পাওনা ছিল তার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তার সেই দেবার অধিকারকে হরন করে নেয়া হলো অকালে জোর করে। তেতাল্লিশ বছর তো সব নয়, জীবন তো আরো প্রলম্বিত হতে পারতো।

যেহেতু অভিজিত তার পিতার চিন্তাকে ধারন করতো, তাই তার কথা বলতে গেলে তার পিতা অজয় রায়ের কথাও এসে যায়। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে অজয় রায় সন্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন, অস্ত্র হাতে লড়েছেন শত্রুর সাথে। তিনি জ্ঞানজীবি, পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও রক্তে-ঘামে শ্রমসাধ্য সমরে জীবন বাজী রাখতে এতটুকু কুন্ঠিত হননি। কারন সেটা ছিল ন্যায়-নীতি আর মানবিকতার তাকিদ। তার মত মানুষের পক্ষে সেই সময় ঐ ডাক অস্বীকার করার কোন উপায় ছিল না। তিনি একজন জাত শিক্ষক। একজন শিক্ষাবিদও বটে। পদার্থ বিজ্ঞানের সাথে তিনি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। পদার্থ বিজ্ঞানের উপরে তার লেখা দুটি গবেষনা প্রবন্ধ নোবেল কমিটিতে আলোচিত হয়েছিল। বাংলাদেশের সবগুলো গণআন্দোলনে তিনি সামনের কাতারে ছিলেন। অতি সংক্ষেপে এই হচ্ছেন একজন প্রফেসার অজয় রায়ের কথা। আমরা কি পেরেছি এই নিবেদিত প্রাণ মানুষটার যোগ্য প্রাপ্তিটুকু, সন্মানটুকু দিতে? পারিনি, পারলে এই বয়সে তার পিঠে আমরা পুত্রের মৃতদেহটা তুলে দিতে পারতাম না। এই অভিশাপের দায় কমবেশী সবার।

জ্ঞানীরা বলেন, বিজ্ঞানে মৌলিক আবিস্কার আসে মনের অনেক গভীরতা থেকে, যেমন কালজয়ী সাহিত্য আসে মনের মিথো-পোয়েটিক স্তর থেকে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে। বিজ্ঞানের আবিস্কার আলোর মুখ দেখে তিনটি মানবিক দক্ষতার ভিতর দিয়ে- কল্পনা, অগ্র-ধারনা ও বুদ্ধিমত্তা। তাই একেবারে শুরুতে কবি ও বিজ্ঞানী প্রায় একই ভাবে কল্পনা করেন। এই কারনে বিজ্ঞানকে মানবিকতা থেকে আলাদা করা যায় না। তবে বিজ্ঞান যখন বুদ্ধিমত্তার স্তরে চলে আসে, তখন সেখানে পর্যবেক্ষন, পরীক্ষা, নিরীক্ষা, এই ব্যবহারিক উপাদানগুলোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তার মানে এই নয়, এই উপাদানগুলো একমাত্র বিজ্ঞান ছাড়া আর কোথাও ব্যবহার করা যাবে না। এমন ট্যাবু গ্রহনযোগ্য নয়। তবে ধর্ম-চিন্তায় ভক্ত কতৃক ব্যবহৃত বিশ্বাস ও ভক্তি বিজ্ঞানে ব্যাবহারের উপযোগী নয়, করা সম্ভবও নয়। তবে ধর্ম আলোচনায় ও গবেষনায় পর্যবেক্ষন-পরীক্ষা-নিরীক্ষার মত বিশ্বজনিন উপাদান ব্যবহার করা যায় সার্থক ভাবে। ভাল ফলও মেলে তাতে। ধর্মের উপযোগীতা ও সার প্রমানের জন্যে তার ইতিহাস ও দর্শনে বিজ্ঞানের হাতিয়ারগুলো ব্যবহারের ফলে ধর্ম আরো বেশী অসার হয়ে পড়ে। এতে বিজ্ঞানের হাতিয়ারের কোন ত্রুটি নেই। এই কারনে জ্ঞানীরা বলেন, ধর্ম বুঝতে হলে তার ইতিহাস ও দর্শন জানা উচিত। ধর্ম আর বিজ্ঞান বিষয়ে আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, কেউ কেউ বিজ্ঞানের ধারালো হাতিয়ারগুলো ধর্মের ব্যাপারেও ব্যবহার করেছেন বেশ সার্থক ভাবে। রিচার্ড ডকিন্স এমন কিছু মানুষের একজন। ফেইথ-ভাইরাস শব্দটাও তার আবিস্কার। তিনি তার বিজ্ঞান রচনায় এই ফেইথ-ভাইরাসকে বিজ্ঞানের হাতিয়ার আর দার্শনিক যুক্তির সমন্বয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সুখের বিষয় তিনি বাংলাদেশের কেউ না, তাই জানে বেঁচে আছেন। পক্ষান্তরে অভিজিত রায় সেই একই বিষয়ের বাংলা সংস্করন নিজের গবেষনার নিক্তিতে ওজন করে যখন সেটা বিশ্বাসের ভাররাস নামে বাংলার পাঠকদের জন্যে তুলে ধরলেন, তখন তিনি বাংলাদেশের অনেক পাঠকের কাছে মোরতাদ হয়ে উঠলেন রাতারাতি। এই অপরাধে তার মস্তক দাবী করা হলো। একসময় সুযোগ বুঝে সেই মাথাও নিয়ে নেয়া হলো। মাটির এমনই গুন।

একটা প্রতিভা রাতারাতি গজিয়ে উঠতে পারে না। তার জন্যে অনেকের অবদান থাকে। মা-বাবা-পরবার, শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশি এমন কি যে পাঠাগারে গিয়ে সে বই পড়ে সেই পাঠাগারের বইগুলোরও অবদান থাকে একটা প্রতিভার সৃষ্টিতে ও বিকাশে। আমাদের সবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশিষে অভিজিত আমাদের জন্যে দিনে দিনে একজন অভিজিত হয়ে উঠেছিল। একটা মুক্ত চিন্তার ধারা শুধু এক যুগের জন্যে তৈরী হয় না। পৃথিবী শেষ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্তরে স্তরে সেই চিন্তা রাজি বিকশিত হতে থাকে। কিন্তু অভিজিতের প্রজ্ঞার ভৌত-বিকাশকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক আগামীজনের যে অপুরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল সেই ক্ষতি পুরণের দাবী আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। দুই উপায়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া যেতে পারে- নিখুত, অনাহত অবস্থায় তাকে পুনর্জীবনে ফিরিয়ে দিয়ে, অথবা যারা এই দুস্কৃতির হোতা ও পিতা তাদের প্রচলিত আইনের কাছে নিশ্বর্ত আত্মসমর্পনের মাধ্যমে, যাতে আগামীতে আর কোন অভিজিতকে এইভাবে ঝরে পড়তে না হয়, তার নিশ্চয়তা বিধানে সহায়ক হয়। প্রথমটা অসম্ভব হলেও দ্বিতীয়াটা সম্ভব। কিন্তু এই সম্ভাব্যতা নিশ্চিত করার জন্যে যে নৈতিক শক্তির প্রয়োজন তা দেশে আছে কি?

একজন ম্যজিস্ট্রেট, একজন চিকিতসক, একজন সচিব একটু খাটাখাটনি করলেই তৈরী হয়ে যায়। তারা যে গণ্ডায় গণ্ডায় পয়দা হয় তা তো সরকারী কর্মকমিশনের প্রতিযোগীদের সংখ্যা দেখলেই বুঝা যায়। কিন্তু একজন সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, বিশ্বনেতা বা লেখক কিভাবে কোথায় তৈরী হয় তা কারও জানা নেই। কোন প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার মাধ্যমেও তাদের উঠিয়ে আনা সম্ভব নয়। সংখ্যায় অল্প হলেও তারা জন্মে, কিন্তু কিভাবে তারা সার্বজনিন কল্যানের পথিকৃত হয়ে উঠেন তা অজ্ঞাত। অভিজিত রায় তেমন একজন গবেষক ও লেখক, যার চিন্তা-চেতনার উপযোগীতা ধীরে ধীরে সার্বজনিন হয়ে উঠেছিল। তার ব্যক্তি জীবন পর্যালোচনা করলে সেখানে একটা আলোকিত অবস্থা খুব সহজে দৃষ্টিগোচর হবে। আপন মেধা ও দক্ষতার বলে অভিজিত দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রে সুউচ্চ পেশাজীবি হওয়া সত্বেও কোন টুকরো লেখায় বা কথায় কখনও কেউ প্রত্যাক্ষ করেনি তাদের পেশাগত সাফল্যের কাহীনি। তাদের এই বিনয় ও বদান্যতাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ব্যক্তিপুজা নয়, অনাবশ্যক প্রশংসা নয়, অন্যের প্রয়োজনে নির্বাচিত ব্যক্তির জীবনাচারকে লোক সমক্ষে তুলে ধরতে হয়, যাতে আগামীর মানুষ তাকে রোল মডেল হিসাবে নিজেদের জীবনের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে। কেন জীবিত মানুষেরা মৃতকে এতটা সন্মান দিয়ে সতকার সম্পন্ন করে? তাতে কি মৃতের কোন লাভ বা ক্ষতি হয়? মৃতের কিছু যায় আসে না তাতে। যা কিছু উপকার সব হয় জীবিতদের। মানুষ হিসাবে তারা নিজেদের সন্মানিত ভাবতে শেখে, সন্মানজনক কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। ঠিক সেই কারনেই মৃত অভিজিতের ব্যক্তিজীবনকে তুলে আনতে হবে সবার সামনে। অনুকরনীয় দৃষ্টান্তের এই সংকটের দিনে তার ব্যক্তিজীবন আগামী প্রজন্মকে আলো দেখাবে। তার এইসব ব্যক্তিগত জীবনের খুটিনাটি একদিন স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে সামনে আসবে এবং মানুষ অবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করবে একজন আলোকিত লেখকের চিন্তা-চেতনা আর জীবনাচারের মধ্যে বাস্তবিক কোন তফাত থাকে না।

সম্ভবতঃ ২০০০ সালে অধ্যপক অজয় রায়ের হাতে মুক্তমনা ব্লগের জন্ম হয়। পরে তার সুযোগ্য উত্তরাধিকার অভিজিত রায় এটাকে আরো পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করেন। বহু লেখকের সমন্বয় ঘটান হয় ব্লগে। মানুষকে বিজ্ঞান চেতনায় আলোকিত করার স্বপ্ন নিয়ে একদিন যে মুক্তমনা ফোরামের জন্ম হয়েছিল প্রফেসর অজয় রায়ের হাত ধরে, তা অনেকটা সফলতার মুখ দেখে অভিজিতের প্রজ্ঞা ও শ্রমে। যুক্তির আলোকে আসতে হলে আগে মনকে মুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে। শুরু হয় যুক্তি ও বিজ্ঞানের চর্চা। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদির মাধ্যমে এই ফোরামে লেখকরা তাদের মেধা-মননের উতকর্ষতা তুলে ধরতে সক্ষম হয় পাঠকের সামনে। প্রদীপের নীচে থাকে অন্ধকারের রাজত্ব। এই ফোরামের মাধ্যমে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে যেমন স্বাধীন চিন্তকের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধকারও সংগঠিত হতে থাকে সুজোগের অপেক্ষায়। মুক্তচিন্তা ও যুক্তিতে তাদের ভয়। তাই তারা মসীর উত্তর দেয় আসীর মাধ্যমে। মুক্তচিন্তার মানুষেরা রক্ষনাত্বক ভাবে সংগঠিত না হওয়ায় সহজে তাদের আক্রমনের স্বীকার হয়। লেখক অভিজিত রায়ের হত্যা সেই ফ্যানাটিক শক্তির প্রতিক্রীয়াশীলতার পরম্পরা। প্রশ্ন উঠতে পারে, এতটা বেপরোয়া হবার সুযোগ তারা কিভাবে পেল? এই প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির ভিতরেই পাওয়া যাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, যখন যে বা যারা ক্ষমতায় এসেছে বা আসতে চেয়েছে তারাই এই বিনাশী শক্তিটার তোষণ করে ধন্য হয়েছে, ফায়দা লুটেছে। বলতে দ্বীধা নেই, এদেশের রাজনীতি সেই একাত্তর থেকেই অন্ধকারে যাত্রা করেছিল। রাজনীতি যত বেশী অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে যাত্রা করবে, এই ফ্যনাটিক শক্তি ততো বেশী পুষ্টিধর হতে থাকবে নিঃসন্দেহে।

একথা এখন বলা যায়, বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার মানুষেরা একধরনের অস্তিত্ব সংকটের ভিতরে অবস্থান করছে, যদিও তারা কারও অস্তিত্বের জন্যে হুমকি নয়। স্বাধীন চিন্তার প্রবাহ এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের সংগঠিত হওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। আক্রমনাত্বক না হয়ে রক্ষনাত্বক উপায়ে সংগঠিত হতে হবে। নিজেদের ভিতরে বর্ণচোরা বিপদ যদি কিছু থেকে থাকে, সেসব বাদ দিয়ে সুদ্ধিকরনের মাধ্যমে শিশা-গলানো একতা গড়ে তুলতে হবে। মুক্তচিন্তার নিরবিচ্ছিন্নতা জারি রাখতে হলে নিজেদেরকে ছোট ছোট স্বার্থ-দ্বন্দ্বের কারণে বিচ্ছিন্ন রাখা চলবে না। অনলাইন ও অফলাইনে উভয় জগতে সক্রীয় হয়ে সংঘবদ্ধ হওয়ার কার্যকর কর্মপদ্ধতি প্রনয়ন করতে হবে। আজ অভিজিত নেই, কিন্তু তার শূণ্যতা বোধ আর শোক আজো বেঁচে আছে সকলের মাঝে। সময়ে সাথে সেসবও ম্লান হয়ে আসবে। কিন্ত অভিজিত অম্লানতা নিয়ে টিকে থাকবে যদি আমরা মুক্ত চিন্তার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকিত পথ থেকে সরে না দাড়াই। এই আলো টিকে থাকে অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এই আলো জমাট অন্ধকারের বুক ফেটে বেরিয়ে এসে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। এই আলো শহীদ অভিজিতের। এই আলো আমাদের সবার।

অন্ধকারের উতস থেকে উতসরিত আলো।
সে তোমারই আলো।
সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভাল,
সে তোমারই আলো।

Saiful Islam

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.

Most popular