Atheist Chapter
ডেকচি

ডেকচি

লেখক: জান্নাতুন নাঈম প্রীতি

সে মেলাদিন আগের কথা,সোহাগপুর গ্রামে একটা ডেকচি কেনা হয়েছিল এককালে। এতবড় ডেকচি সে গ্রামের ছেলেপুলেরা আগে কখনো দেখেনি। মসজিদের শিরনী রান্না হত এই ডেকচিতে, বিয়ের পোলাও রান্না হত এই ডেকচিতে। ডেকচি দিয়ে কাজের অন্ত ছিলোনা গ্রামের লোকের, আবার কাজ ফুরালে গালি দেয়ারও অন্ত ছিলোনা।
গালি দেয়ার কেন অন্ত ছিলোনা সেই ঘটনাটা বিতং করে বলাই ভালো।
গ্রামের দুরন্ত দস্যি মেয়ে বলতে যা বুঝায় ফুলবানু সেই রকমের মেয়ে। গ্রামের লোকেরা ডাকে- ফুলি। এই মেয়ের জন্ম দিতেই মেয়ের মা মরে গেছে তাই অপয়া মেয়ে। জন্মের দুইমাস পরে কলেরা হয়ে বাবাও মরে প্রমাণ করলো মেয়ে তার অপয়ার সাত কলা পূর্ণ করেছে। মা বাপ মরা ফুলির আশ্রয় হল বুড়ি নানী, সেও মরার দুইবছর আগ থেকে ধরে বাতের বিষব্যাথায় শয্যাশায়ী ছিল। তাই যখন কোনো পোয়াতি বউয়ের বাচ্চা হয় তখন আঁতুড়ঘরের ত্রিসীমানায় সেইবাড়ির লোকেরা ফুলিকে ঘেঁষতে দেয়না, ঘেঁষতে দিলেও পীরসাহেবের পানি পড়া অথবা ঘরে কবিরাজ দিয়ে বাঁধন দিতে হয়। গাছে ওঠা থেকে শুরু করে দিনে আট থেকে দশবার বর্ষাকালে নদীর এপার ওপার করা থেকে শুরু করে এহেন অকম্ম নেই যেটা ফুলি পারতনা। এই-ই পিয়ারা গাছের ডালে বসে খাচ্ছে আবার সেই-ই বাবুই পাখির বাচ্চা ধরতে গাছে উঠছে। গ্রামের লোকের ভাষায়- এক্কাবারে বৈদর মাইয়া!
অপয়া হলে কি হবে, মেয়ের গায়ের রঙ ছিল দুধে আলতা, এমনই দুধে আলতা যে গায়ে একটা টোকা পড়লেই পাকা ডালিমের মতন লাল হয়ে যেত। তার দস্যিপনার শেষ নেই আবার শুরুও নেই। যেদিন গাঁয়ে কারো বিয়ে হত আর রাতে সুর করে বিয়ের গীত গাওয়া হত শুধুমাত্র সেইদিনই তাকে সবচে শান্তশিষ্ট দেখাত। সইয়েরা সবাই আলতো করে তার গায়ে ধাক্কা দিলে সে শরমে লাল হয়ে উঠত! হয়ত নিজের বিয়ের কথা ভেবে আহ্লাদ হত, অথবা বিয়ের সাজে নিজেকে কল্পনা করতেই লজ্জা লাগতো।

মেম্বারের ছোটো ভাই রহমত শেখের ছেলে সুরুজ শেখ আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা যেদিন ফুলবানুকে পাটক্ষেতে নিয়ে যায় সেই দিনটা ছিল মেঘলা, হাওয়া ছাড়েনি তখনো গুমোট ভ্যাপসায়। বেলা তখন তিনটা কি সাড়ে তিনটা বাজে হয়ত। গ্রামের লোকেরা ভাত খেয়ে ওইসময়টায় ঘুমায়, ঘুমায় না বলে বলা ভালো জিরিয়ে নেয়। পাটক্ষেতের পাশ দিয়ে নুরু মুন্সী যাচ্ছিল বলে সে যাত্রায় রক্ষা- নাইলে মেয়ের আর গাঁয়ে জায়গা থাকতোনা।
পরেরদিন আমতলায় বসলো বিচার। মেম্বারের হঠাৎ করেই পেটের পীড়া শুরু হয়েছে। সে আসবো আসি করেও আসতে পারলোনা। ফুলবানু জানতেও পারলোনা সুরুজ শেখের আপন চাচা ইচ্ছা করেই আসেনি সেদিন। পেটের পীড়ার কথা বলে ছোটোছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে আনা দই গিলছে। মেম্বার ছাড়াই দুইচার জন মুরুব্বী মিলে নিষ্পত্তি হয়ে গেল ভালোয় ভালোয়।
নিষ্পত্তি হল সুরুজ শেখ আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের ক্ষতিপূরণ দেয়া লাগবে ফুলিকে। পাটক্ষেতে হয়ত নিয়ে গেছে কিন্তু সম্ভ্রম তো আর হারাতে হয়নি তাই মামলা খতম, পয়সা হজম। সাতশটা টাকা ক্ষতিপূরণের… সেই টাকা কি ফুলবানু পেয়েছিল?
-না, পায়নাই।
ওইটাকা কি নেয়া যায়? বুড়ি নানীর বাতের ব্যাথার মলম তো মাগনাই পাওয়া যায় কবরেজ বাড়ি গেলে! পেটে ভাত না থাকলেও তো খুদ খাওয়া যায়… কিন্তু নিজের ইজ্জত দিয়ে যে টাকা পাওয়া যায় তা কি নিতে হয়?
-হয়না।
অভাব থাকলেও দান করে দিতে হয়!
দান করে দিতে হয় বলেই মুরুব্বীরা ঠিক করলো সেই টাকা দিয়ে পাতিল কেনা হবে, যার আরেক নাম ডেকচি। গ্রামের তাবৎ বিয়ে বলো, শোবা বলো, চল্লিশা বলো, তাতে যত খানদানি রান্না হবে তা হবে ওই ডেকচিতে। ফুলবানুর অপবাদও ঘুচল, নিয়ামতও মিলল!
মারাহাবা…মারহাবা!

বাস্তবে ঘটেছিল তার উল্টা, ফুলবানুর গাঁয়ের রঙ যতই দুধে আলতা ভিজানো পাউরুটির মতন হোক, যতই বিয়ের সম্বন্ধ আসুক তারা আর ডেকচির কথা শুনে আগায় না। অপয়া মেয়ে মাকে খেয়েছে, বাপকে খেয়েছে, না জানে কখন স্বামীকেও খায়!
কোন শাশুড়ির ঠায় পড়েছে, কার ছেলের দায় পড়েছে!

কোনো বাড়িতে বিবাহের মধ্যে ক্যাচাল বাধলে সবাই অপয়া ফুলির কথা বলে, অপয়া ফুলির বিচারের টাকার ডেকচির কারণেই যত গোল বাঁধে। গেলবছর যখন হারুন তালুকদারের মেয়ের জামাই তার মেয়েকে তালাক দিলো তখন মেয়ে বাপের বাড়ি ফিরে কাঁদতে কাঁদতে তার পোড়া কপালের পেছনে ওই ডেকচির ভূমিকা বিতং করে বলল।
আড়াল থেকে ফুলি সবই শোনে, আর তার মায়া হরিণের মতন বড় বড় চোখ পানিতে ভরে যায়।

গাঁয়ে একটা বিয়ের কাইজ্জা হয়
ডেকচি নিয়ে কথা হয়।
গাঁয়ে একটা নালিশের সালিস হয়,
ডেকচি নিয়ে কথা হয়।

মোটকথা দুনিয়ার যেখানে যাই ঘটুক না কেন সবকিছুতে ডেকচি আর ডেকচির পিছনের ফুলি একবার না একবার দায়ী হবেই!
কে কি করেছিল জানা যায়নি পরে, তবে ফুলবানুর নানী মরে যাওয়ার একদিন পর থেকে সারা গ্রাম খুঁজেও ফুলবানুকে পাওয়া গেলনা। গেলনা, গেলনা তো গেলোই না! অপয়া মেয়ের সঙ্গে জীন ভূত ছিল তারা ওকে দেশান্তরী করেছে গাঁয়ের লোক এমন কথাও বলল।
তারও তিনদিন পরে নদীর ঘাটে পচা গলা যে লাশ পাওয়া গেল সেইটা ছিল ফুলবানুর। সে কিভাবে মরেছে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে তা নিয়ে কেউ কিচ্ছু বলল না! ত্রিকূলে যার কেউ নাই সে মরলেই কি আর বাঁচলেই কি?
আমেনা শাড়ি দেখে তার সই ফুলিকে চিনল। মসজিদের ইমাম সাহেব জানাজা পড়াতে রাজি হলেন না কিছুতেই। ফুলবানুর লাশ আর কবর দেয়া হল না, ভাসিয়ে দেয়া হল শীতলক্ষ্যা নদীতে। দূর থেকে যতক্ষণ দেখা গেল ফুলির সই আমেনাই শুধু তাকিয়েছিল, আমেনার চোখটা ছলছল করছিল- আহারে, মানুষের এইভাবে মরতে হয়? হাহ্‌… মেয়েমানুষের কি কপাল! বর্ষার জোয়ারে দুলতে দুলতে ফুলি দূর থেকে দূরেই যাচ্ছিল…আর ওর লাল শাড়িটা নৌকার খসে পরা পালের মতন ওর শরীর বারবার ঢেকে দিচ্ছিল।

আমেনার মা আমেনার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়িতে নিয়ে এসে বলল- কান্দিস না, কাইন্দা কি অইবো অ্যাঁ? অপয়া মাইয়া ভাইসা গেছে বালা হইছে, মুছিবত উইঠা গেছে গা গাঁও থেইক্কা…
তারপর পানের বাটা থেকে আয়েশ করে এক খিলি পান চিবুতে চিবুতে করিমন বিবি বললেন- হুনছছ, কাইল আমগো আঁহির সম্বন্ধ আইবো… তর বাপ হাটে গেছে, কত লোক আইবো তা তো কওন যায় না। যা তো, দৌড় দিয়া ডেকচিডা আইনা দে!

আরিফুর রহমান

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.

Most popular