এক
“আমি রাজাকার… এখন কে কোন বাল ফালাবে…”
“বল বল কীভাবে কি করছি… বল… তোর বোনকে কি করছি বল….”
অসভ্য নোংরা পশু সাকা চৌধুরীর অসংখ্য অশ্রাব্য উক্তির মধ্যে উপরের দুটো অন্যতম। কারণ এই উক্তিগুলো প্রকাশ্যে আদালতে বিচারকের সামনে বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিলো। আগামী ২৯ তারিখে এই বন্য শূয়রের আপিলের রায়।
মানুষ আর পশুর এই যুদ্ধে দেখা যাক কে জয়ী হয়। সভ্যতা আর বর্বরতার যুদ্ধে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত টানা তিরিশ বছর সংসদ সদস্য থাকা সাবেক এই মন্ত্রীর জন্য কি উপহার রেখেছে সেটা জানার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন “ওয়াজেদ মিয়ার কি সোনা নাই… আমার সোনা নিয়া টানাটানি কেন…”, “ওনার বাসরের শাড়ি তো আমার দেয়া…”। বি এন পি নেত্রীকে কুকুর সম্বোধন করে বলেছিলেন “আগে কুকুর লেজ নাড়ত… আজকাল লেজ কুকুর নাড়ে”, “আমাদের ম্যাডামের আবার অযোগ্য সন্তানদের জন্য অনেক ভালোবাসা…”। এরকম অজস্র উক্তি করেও এই পশুটি কিন্তু দেশের সবগুলো রাজনৈতিক দলের উঁচু উঁচু পদে কোন না কোন ভাবে জড়িত ছিলো। সাকার ছেলে মেয়েদের বিয়েতে পাকিস্তানী এম্পি মন্ত্রিরা এসেছিলো। সাকা মন্ত্রী হলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি তাকে ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলো। এটা স্বাধীনতার পরে প্রথম এমন কোন ঘটনা।
শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক এই লোকটা নির্বিচারে মানুষ মেরেছে, অজস্র ধর্ষণ করেছে একাত্তরের আগে ও পরে। আমি অনেককেই বলতে শুনেছি পাকিস্তান আমলের একজন স্পিকারের সন্তানের কাছ থেকে এরকম বর্বরোচিত কর্মকান্ড কেউ সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। তারা ভুলে যান যে সাকা চৌধুরীর পিতা ফকা নিজেও খুন ধর্ষণের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলো। কিছু মানুষ রক্ত পছন্দ করে, নির্মমতা পছন্দ করে। যারা বারবার ফকার রাজনৈতিক পরিচয়কে মহৎ করে তুলতে চান তারা ভুলে যান যে সেই ফকা চৌধুরী ১৭ লক্ষ টাকা সহ শুধু জাঙ্গিয়া পরা অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলো এবং পাবলিকের উত্তম-মধ্যমে অর্ধমৃত অবস্থায় থানায় সোপর্দ হয়েছিলো।
কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, নিপাট ভদ্রলোক, মানুষের উপকারে ব্রত- নূতন চন্দ্র সিংহ-কে একেবারে বিনা কারণে হত্যা করে সাকা। কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ে অপারেশন করতে এসে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নূতন চন্দ্র সিংহের ব্যাবহারে আপ্লুত হয়ে ফিরেই যাচ্ছিলো, কিন্তু এই পশুর কারণে সেদিন তারা ফিরে আসে। তিনটা গুলির পরেও সাকা সেই মৃত দেহের ওপর পুরো বন্দুক খালি করে। শুধু বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে।
সাকার গুডহিলের যেই বাসা ছিলো চট্রগ্রামের গ্যাস চেম্বার সেটা শুধু ১৯৭১ সালেই না এর পরেও মানুষকে অত্যাচার নির্যাতন করার স্থান হিসেবে পরিচিত ছিলো। নব্বুয়ের দশকেও গুডহিলের সুনাম ছিলো মানুষ হত্যার স্থান হিসেবে।
সবশেষে একটা কথাই বলবো।
আর কিছু না হোক…
অত্যাচারে কাতর মৃতপ্রায় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা-
জীবনে শেষ বারের মত পানি খেতে চাইলে যেই সাকা তার প্রস্রাব পান করতে বাধ্য করতো…
তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার সময় যেন-
মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়…
দুই.
রায় ঘোষণার আগে আগে নতুন নাটকের সূচনা
সাকা চৌধুরী নাকি ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চের পর দেশেই ছিলো্ না…
উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পাকিস্তানে ছিলো…
লও ঠ্যালা…
তাহলে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে কে হত্যা করলো…?
নাকি কেউ তাঁকে হত্যা করে নাই…
তিনি এখনো জীবিত আছেন…?
মানুষ আজকাল খুবই বিরক্ত রাজাকারদের মামলা পরিচলনাকারিদের এহেন যুক্তিতে। একটা না দুইটা না এই পর্যন্ত পরপর তিনজন যুদ্ধাপরাধীর পরিচয় পরিবর্তন করে মামলা পরিচালনা করেছে এই লোকগুলো।
এই কাদের মোল্লা নাকি সেই কাদের মোল্লা না,
কাদের মোল্লা নাকি ১৯৭১ সালে মিরপুর কি জিনিস সেটিও জানতো না; কসাই কাদের নামের কোন এক বিহারীর অপরাধের দায় মোল্লা সাহেবের ওপর চাপানো হয়েছে। তারপর এই সাইদি নাকি সেই সাইদি না; দেলু শিকদার নামের কোন মানুষের অপরাধের এই নিরপরাধ মানুষটাকে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি নাকি তখন দুগ্ধপোস্য শিশু; জামাতের নামও শোনেনি।
এবং এখন এই সাকা চৌধুরীও সেই সাকা না,
সাকা তখন পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন।
ডিফেন্স এই তিনজনের ক্ষেত্রে একই নিয়মে মামলা পরিচলনা করেছে। বারবার বলা হয়েছে ‘এই কাদের/সাইদি/সাকা নাকি যুদ্ধকালীন গনহত্যায় নেতৃত্ব দেয়া সেই কাদের/সাইদি/সাকা নয়’ অন্য কোন মানুষের অপরাধের দায়ে তাদের মক্কেলদের ফাঁসানো হচ্ছে। তদের বিরুদ্ধে যে অপরাধের দায় দেয়া হয়েছে সেই অপরাধগুলো সংগঠিত হলেও তাদের মক্কেল সেখানে উপস্থিত ছিলো না!!!
মজাটা হচ্ছে একই ঘটনা একজনের ক্ষেত্রে হলে সত্যি হতেও পারতো-
কিন্তু পরপর দুইজন না তিন তিন জনের ক্ষেত্রে মেনে নেয়া একটু কষ্টকর বৈ কি।
আসলে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় কাদের মোল্লা, সাইদি এবং সাকা চৌধুরী তিনজনই ১৯৭১ সালে তেমন পরিচিত কেউ ছিলো না কিন্তু অন্যদিকে মুজাহিদ, নিজামি, গোলাম আযম এরা যথাক্রমে থানা, জেলা, শহর, দেশ এমনকি আন্তর্জাতিক ভাবেও সুপরিচিত ছিলো ১৯৭১-এর আগে থেকেই, এরা সবাই একেবারে কেন্দ্রে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো রাজাকার-আলবদর-আলশামস কিলিং স্কোয়াডদের। আর তাই তাদের পরিচয় গোপন করে অন্য কাউকে মুজাহিদ/নিজামি/গোলাম বানানোর নাটক জামাত করতে পারেনি। এটা তাদের একটা স্ট্রাটিজি।
যাই হোক রায় প্রকাশের পর থলের বিড়াল বের হলো; মোটমাট শ’খানেক সাক্ষী আদালতে দাঁড়িয়ে সাইদি, কাদের মোল্লা, সাকাকে সনাক্ত করল। এর বাইরেও এই ফেসবুকে আমরা দেখলাম কাদের মোল্লার এক সময়ের সহপাঠী মোজাম্মেল এইচ খান একটা স্ট্যঅ্সা দিয়ে সনাক্ত করলেন মোল্লাকে।
মোজাম্মেল কাকা যতদিন জীবিত আছেন যে কেউ তাদের ‘কাদের মোল্লা’ বিভ্রান্তি নিয়ে একেবারে সরাসরি আলোচনা করতে পারবেন। এছাড়া আরেকজন সেলিব্রেটি সাক্ষী শহিদুল হোক মামাও যথেষ্ট এভেইলেবল। এছাড়া মুক্তমনায় অভিজিৎ’দা আমার সাথে একটি ব্লগ লিখেছিলেন “কসাই কাদের আর মোল্লা কাদের নাকি এক ব্যাক্তি ছিলেন না; বীরাঙ্গনা মোমেনা বেগম আমায় ক্ষমা করবেন…”। নিঝুম মজুমদার লিখেছিলেন দি কিউরিয়াস কেইস অফ কাদের মোল্লা এবং সাক্ষী মোমেনা
এই দুটো লেখা একত্রিত করে বিডি নিউযে প্রকাশিত হয় কালজয়ী কাদের মোল্লার আসল নকল: একটি নির্মোহ অনুসন্ধান
সাইদির বেলায়ও তার হিসাব গোলমাল করলো তার নিজের একটা সাক্ষাৎকার, নিজের কণ্ঠে স্বীকার করলো তার জন্ম পিরোজপুর জেলায়, ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৪০ সালে। তার মানে ১৯৭১ সালে ৩১ বছরের তাগড়া নওজোয়ান। তারপর বেফাঁসে আরও একটা কথা বলে ফেললেন নিজ মুখেই- ১৯৭০ সাল থেকে সাইদি জামাতের রোকন ছিলো।
তা- ১৯৭০ সালে জামাতের উচ্চপদস্থ একজন ব্যাক্তি ১৯৭১ সালে কি কি করতে পারে সেটা বাংলাদেশের মানুষদের ধারণায় আছে। এরপর প্রচুর সাক্ষ্য-প্রমাণ তো আছেই।
সেই সাক্ষাৎকারের ইউটিউব
https://www.youtube.com/watch?v=CypLFq9vFf8
এরপর এলো সাকা চৌধুরী, এই নিস্পাপ মানুষটি নাকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণও শুনেছিলেন। তারপর ২৯ মার্চ করাচী চলে যান পড়ালেখা করতে। আসামিপক্ষ ৪-জন সাক্ষী আনলেন তাদের দাবীর পক্ষে- একজন সাক্ষী সাকা নিজে!! (বিনোদন), একজন সাকার রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়!! (রায়ে ফাস্ট কাজিন লেখা হয়েছে), একজন সাকার স্ত্রীর বোনের স্বামী!! (বিনোদন), একজন সাকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু!! (বিনোদন)।
সাক্ষির নমুনা দেখুন!!
আত্মিয়-স্বজন আর আসামি স্বয়ং নিজেকে শনাক্ত করলো!!!
অপরদিকে আমাদের প্রসিকিউশান সাকার ১৯৭১ সালে এই দেশে উপস্থিতির পক্ষে এমন কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করলেন; যেগুলো এক কথায় ফ্যান্টাসটিক!!!
মুক্তিযুদ্ধের সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বর্বর নির্যাতনের জন্য তাকে হত্যা চেষ্টায় তিনবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতিবারই একটুর জন্য বেঁচে গেলেও শেষবারের অভিযানে গুরুতর আহত হয় সাকা। নিহত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ির চালক। পরদিন পাকিস্তান টাইমস, বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার খবরে তাঁর আহত হওয়ার কথা জানা যায়। লাহোরের পাকিস্তান টাইমসে সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছিল পিপিআইয়ের বরাত দিয়ে। পাকিস্তান টাইমসের বরাত দিয়ে পরে ওই সংবাদ প্রকাশ করে বাংলা দৈনিক পাকিস্তানও।
‘বোমার আঘাতে ফজলুল কাদেরের ছেলে আহত : গুলিতে ড্রাইভার নিহত’ শিরোনামে ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলের ওপর হামলা চালালে তিনি আহত হন। গত ২০ শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে এই ঘটনা ঘটে। গত শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) রাতে ঢাকায় জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, যে গাড়ীতে তাঁর ছেলে ছিল সে গাড়ির ড্রাইভার এই হামলার ফলে নিহত হয়েছে।’
দৈনিক পাকিস্তানের ওই সংবাদে ফজলুল কাদের চৌধুরীর আহত ছেলের নাম উল্লেখ না করা হলেও তখনকার পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো এক গোপন রিপোর্টে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নাম রয়েছে। ফোর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান ফর দ্য সেকেন্ড হাফ অব সেপ্টেম্বর ১৯৭১ শীর্ষক ওই রিপোর্টে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আহত হওয়ার ঘটনার বিবরণ আছে। আদালতে সেই ফাইলও যুক্ত করা হয়েছে।
সেখান থেকে আহত সাকাকে চট্রগ্রাম মেডিক্যালে নেয়া হয় এবং সেখানকার তখনাকর কর্মরত ডাক্তার এ কে এম শরিফুদ্দিন ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীকে সনাক্ত করেন। তার সু চিকিৎসা যে নিশ্চিত হয়েছিলো তার পূর্ণাঙ্গ বিবিরণ দেন।
এছাড়া সাক্ষী নাম্বার ২, ৪, ৬, ৭, ১৪, ১৫, ১৭, ১৯, ২২, ২৪, ২৮, ৩১, ৩২, ৩৭ -মোট ১৪ জন সাক্ষী মৃত্যুভয়কে পরোয়া না করে ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে সাকাকে সনাক্ত করেছে, এদের অনেকেই তাকে নিজ হাতে খুন করতে দেখেছে। অনেকে দেখেছে পাকিদের গাড়িতে, অনেকে সরাসরি নির্যাতনের শিকার তার হাতে…
স্যালুট রাস্ট্রপক্ষ আইনজীবীদের…
স্যালুট বিচারকদের…
সব শেষে সেই পুরনো কথাই বলবো
আর কিছু না হোক…
অত্যাচারে কাতর মৃতপ্রায় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা-
জীবনে শেষ বারের মত পানি খেতে চাইলে
যেই সাকা তার প্রস্রাব পান করতে বাধ্য করতো…
তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার সময় যেন-
মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়…