Atheist Chapter

বৈষম্য, সহিংস ব্যবস্থা এবং অন্যান্য

একটু দুরে গিয়ে, একটু মাথা ঠাণ্ডা করে, একটু ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে সমাজের বিবর্তনের ধারাটি খেয়াল করে, একটু তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করে যদি বাংলাদেশের দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন এখানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সারা দেশে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন হয়েছে, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসছে প্রবাসী আয় থেকে। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয় বেড়েছে অনেকগুন, ১৯৭২ সালে ১২৯ ডলার থেকে আজকে ১৭০০ ডলার। গড় আয়ু বেড়েছে ২৫ বছর, ১৯৭১ সালে ছিল ৪৭ বছর আর এখন ৭২ বছর।

এই যে অর্থনৈতিক “উন্নতি”, এর প্রধান কারণ বৈশ্বিক ভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ, যেমন গাড়ি, উড়োজাহাজ, কম্পিউটর।এর প্রভাব পরেছে কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষি উৎপাদনে, ফলে খাদ্যের যোগানে, এবং আয়ুর বৃদ্ধিতেও। প্রযুক্তির বিকাশের প্রভাবে তেলের ব্যাবহার বেড়েছে এবং তেলের টাকা জমেছে ইউরোপ আমেরিকার ব্যাংকে এবং সেই টাকা গিয়েছে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের “আধুনিক উন্নয়নের” জন্য বিনিয়োগ ও ঋণ হিসেবে। প্রযুক্তি আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কায়িক শ্রমের ফসল। এই যে চারিদিকে আমরা চকচকে ঝকঝকে “উন্নয়ন” দেখছি, এগুলি সবই মানসিক ও দৈহিক শ্রমের ফল।

এবং এই উন্নতির দ্বিতীয় একটি কারণ সামাজিক রাজনৈতিক।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতা। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের কালে পুঁজিবাদ প্রবৃদ্ধির ও সমৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করে। ২০০২ এর আগে কোন বড় যুদ্ধে না গিয়ে ধ্বংসের বদলে পুনর্গঠনের কাজ করে। এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধারনা প্রচার করতে থাকে, ইউরোপে সামাজিক নিরাপত্তার (ওয়েলফেয়ার) ব্যাবস্থা গড়ে ওঠে, সমাজতন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় পুঁজিবাদ কিছুটা মানবিক হয়ে ওঠে।

“রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের” বিলুপ্তির কারণ ছিল সেখানকার মানুষের পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নয়, “জনগণের সমাজতন্ত্রের” দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা, কারণ তারা সমাজের উপর রাষ্ট্রের বা আমলাতন্ত্রের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ পছন্দ করেনি। কিন্তু সেই লক্ষ্যের রাজনীতিকে নেতৃত্ব দেয়ার কেউ ছিলোনা। ফলে এই সমাজ ফিরে যায়, আবার সেই পুঁজিবাদেই। যেখানে বেকারত্ব, পতিতাবৃত্ত ও চৌর্যবৃত্তি ফিরে আসে পুঁজিবাদের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে।

পুঁজিবাদী “আধুনিক উন্নয়নের” পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক। বাংলাদেশে যা দেখছি, শহরে ফুটপাথে ৩০ হাজার লোক রাত কাটায় যখন ৫০ হাজার ফ্লাট খালি পরে থাকে। প্রায় ৩০% খাবার নষ্ট হয় যখন প্রায় ৩০% লোক তিন বেলা খেতে পায়না। লক্ষ লক্ষ লোক বেকার। খাল, নদী, বন ধ্বংস করা হচ্ছে দেদারসে। পরিবেশ দূষণ আবহাওয়ার ঝুঁকিতে ফেলছে সবাইকেই।

২০০২ এর পরে, আবার আমরা পুঁজিবাদের চরিত্র ও সংকট দেখি, যুদ্ধের ও ধ্বংসের চেহারায়, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, ও সিরিয়ায়।সারা দুনিয়া জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদের উদ্ভব ও নারীর প্রতি সহিংসতায়, মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনে।

সমাজে বৈষম্য ও সহিংসতা বাড়ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু মানুষের মাঝে ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস, লোভ, হিংসা, বিদ্ধেস, বাড়ছে।দুর্নীতি বাড়ছে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ বাড়ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।এগুলো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যার্থ হচ্ছে। কারণ রাষ্ট্র নিজেও আসলে সিণ্ডিকেট দ্বারা প্রভাবিত।সিন্ডিকেট, যারা পুঁজিবাদী বাজার এবং “ভোটের” রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।

বস্ত্রশিল্প সিন্ডিকেট, পরিবহন সিণ্ডিকেট, নিরাপত্তা ব্যাবসা সিন্ডিকেট, ব্যাংকিং সিন্ডিকেট, খাদ্য ব্যাবসা সিন্ডিকেট এবং ধর্মজীবীদের সিণ্ডিকেট। এই সিণ্ডিকেটগুলো তাদের যূথবদ্ধতার কারণে, রাজনৈতিক সরকারের উপর চাপ বজায় রাখতে পারে। সুতরাং এই সিণ্ডিকেটদের (আমলা-কর্পোরেট পুঁজির) ক্ষমতা ও ” পুঁজিবাদী উন্নয়ন” নীতি বহাল থাকলে পুঁজিবাদের সংকটও থাকবে।

দরকার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের। মানে, বৈষম্য ও সহিংসতা পুরপুরি বন্ধ করার জন্য আশু করনীয় ও দীর্ঘমেয়াদী বিকল্প উপস্থাপন, যা এই পুঁজিবাদের উন্নয়ননীতিকে প্রতিস্থাপিত করবে, মানবিক ও শান্তির উন্নয়ন দিয়ে।

আপনারা অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করছেন, আমি কেবল সমালোচনা ও অনুযোগ দেখছি। অন্য কথায়, আড়াল হয়ে যাচ্ছে সমস্যার মুল কারণ ও বিকল্পের আলোচনা। আপনাদের ক্ষোভ আছে, সেই ক্ষোভের প্রকাশ ব্যাবহার করেই সরকার বদল ঘটিয়ে সিন্ডিকেটসমূহ এই বৈষম্য ও সহিংস ব্যাবস্থা অব্যাহত রাখে।(নির্বোধের মত প্রশ্ন করবেন না, “আমরা কি এই সরকারকে সমর্থন করব?”)।

পুরো ব্যাবস্থাটার বদল দরকার। বৈষম্য ও সহিংসতা যে ব্যাবস্থা জন্ম দেয়, সে ব্যাবস্থার উপসর্গ অবাধ লুঠপাট ও নির্বিচার সহিংসতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, এই বিকৃত খণ্ডিত উন্নয়ন এর বিকল্প, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক ও মানবিক উন্নয়নের ভিত্তি যুগিয়েছে। সেই ভিত্তির আলোচনাটা, বিকল্প উন্নয়ন নীতির আলোচনাটা জরুরী।

shahadathosain

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.

Most popular