আমরা যে বাসায় থাকতাম সেখানে প্রায় প্রতি শুক্রবার ওয়াজ মাহফিল এর আয়োজন করা হত। রাস্তাঘাট বন্ধ করে সবাই ওয়াজ মাহফিল এর প্রস্তুতি করতে শুরু করতেন। সোজা পথে কোথাও যাওয়ার জন্য বের হলে অনেকটা ঘুরে প্রধান সড়কে গিয়ে রিক্সা নিতে হতো। সে এক মহা মহোৎসব। মাওলানা মুফতি সাহেবরা আসতেন। শুরু হতো সন্ধ্যা থেকে সারারাত ব্যাপী এই ওয়াজ মাহফিল। কখনও টানা সাতদিন ধরে চলতো।
ওয়াজের সবচেয়ে আশ্চর্য জনক আর মুল আকর্ষণ ছিল ওয়াজ এর মধ্যে বিশাল এক সময় ধরে বাংলাদেশের অমুসলিম সম্প্রদায়ের নারীদেরকে ঘটা করে গালি দেওয়ার পর্ব। বয়স তখন কম থাকায় এত ভাল করে বুঝতাম না যে মাওলানা মুফতি সাহেব কি সুন্দর সুর করে করে অমুসলিম মেয়েদেরকে তার মুখ থেকে বের হওয়া অসভ্য, বিশ্রী রসালো বাক্য ব্যবহার করে ওয়াজ মাহফিল জমিয়ে রাখতো।
খুব আনন্দের সাথে লালসায় ভরা কণ্ঠে বলতেন শাড়ি পরে মেয়েরা কপালে বড় বড় টিপ পরে পুরুষদের নিজেদের দিকে আকর্ষিত করে। শরীরের ভাঁজ দেখিয়ে পুকুর পাড়ে বুকের আঁচল নামিয়ে, হাঁটুর উপরে কাপড় তুলে গোসল করে এমনভাবে যেন মুসলমান পুরুষগণ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে তাদের নজরে পরেন। পুরুষের কী দোষ! তেঁতুল দেখলে যেমন জিভে জল আসে সেটা সবাইকে তখন আবার মনে করিয়ে দিতেন মুফতি সাহেব। তারপর আবার সুর করে করে বলতেন , ‘এইবার বলেন খৎনা দেয়া অঙ্গটা এই দৃশ্য দেইখা যদি নিচ থাইকা সালাম দেওয়ার জন্য দাঁড়াইয়া যায় তখন কি করবেন?’
মুফতি সাহেবদের এমন কোন অশ্রাব্য গালি নেই যে ওই ওয়াজে কানে আসে নাই। দুঃখ হয়, বাংলাদেশের নারীরা আজও সম্মানের সাথে বাঁচতে পারছে না। নারীরা আজও নিজেদেরকে এই রকম জঘন্য লোভাতুর দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে পারেন না। পুরুষ হোক বা নারী হোক তার পরিচয় সে একজন মানুষ। কোরানের কোথায়, কোন আয়াত, কোন সূরায় লেখা আছে যে, তোমরা নারীদেরকে অশ্রাব্য নোংরা ভাষায় গালাগালী করো? তাদেরকে কে ভোগের সামগ্রী ভেবে নিজের ইচ্ছা মতন ব্যাবহার করো। কোথায় লেখা আছে যে শুধু মাত্র পুরুষের সাথে বিছানায় শোবার জন্য নারীদের জন্ম হয়েছে। আমার জানা মতে কোথাও লেখা নাই। একজন নারী, সে যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, কোন ধর্ম গ্রন্থই নারীদের অসম্মানের কথা বলে না। তাহলে কি করে আপনারা অর্থাৎ মাওলাণা, মুফতি সাহেবেরা, কোরানের কোন নিয়মের উপর ভিত্তি করে অমুসলিম নারীদের প্রতি এরকম অসভ্য অশ্রাব্য ভাষার প্রয়োগ করেন? তাহলে কি ওয়াজ মাহফিলে ধর্ম শিক্ষা/ আলোচনার দোহাই দিয়ে কোরানের শিক্ষার বাইরে নিজের বানানো নিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে মানুষকে উস্কে দিচ্ছেন? আপনারা তো ধর্ম আর কোরানের অপ ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের মন বিষিয়ে দিচ্ছেন। প্রকৃত কোরান অবমাননাকারী তো আপনারাই।
স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা বলেছিলেন, ﻭَﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺑُّﻚَ ﻟِﻠْﻤَﻼَﺋِﻜَﺔِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺧَﺎﻟِﻖٌ ﺑَﺸَﺮًﺍ ﻣِّﻦ ﺻَﻠْﺼَﺎﻝٍ ﻣِّﻦْ ﺣَﻤَﺈٍ ﻣَّﺴْﻨُﻮْﻥٍ، ﻓَﺈِﺫَﺍ ﺳَﻮَّﻳْﺘُﻪُ ﻭَﻧَﻔَﺨْﺖُ ﻓِﻴْﻪِ ﻣِﻦ ﺭُّﻭﺣِﻲْ ﻓَﻘَﻌُﻮْﺍ ﻟَﻪُ ﺳَﺎﺟِﺪِﻳْﻦَ – ‘স্মরণ কর সেই সময়ের কথা, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি মিশ্রিত পচা কাদার শুকনো মাটি দিয়ে ‘মানুষ’ সৃষ্টি করব। অতঃপর যখন আমি তার অবয়ব পূর্ণভাবে তৈরী করে ফেলব ও তাতে আমি আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদায় পড়ে যাবে’ (হিজর ১৫/২৮-২৯)
পবিত্র কোরানে উল্লেখ আছে; ওয়া নাফাখুত ফীহি মির রূহি। অর্থাৎ “ আর আমি তাঁর মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম। (সূরা সোয়াদঃ আয়াত -৭২) । এই আয়াত এর মধ্যে দিয়ে আল্লাহ্ বুঝিয়েছেন, মানুষ সৃষ্টির সময় তিনি মানুষের মধ্যে তাঁর রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ্ তালার অংশ আমাদের প্রত্যেকের শরীরে বিদ্যমান। আমরা স্বয়ং আল্লাহ্ তালার নিঃশ্বাস আমাদের শরীরে ধারণ করে আছি। আর যখন আমরা কোনো মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করি তা কি আমরা স্বয়ং আল্লাহ্কে গালিগালাজ করি না? যদি কোনো মানুষকে আঘাত করি, তাদের বাড়ি ঘর ভাঙ্গি, মানুষ হত্যা করি, তাহলে কি আল্লাহ্কে আঘাত করি না? আল্লাহ্র অংশকেই হত্যা করি না? যদি তাই হয়, তখন মাওলানা মুফতি সাহেবদের ধর্মানুভুতিতে আঘাত লাগে না? এতে ইসলামের মান কি খুব বাড়ে? এগুলো করার অর্থ হলো ,আপনাদের স্বার্থের জন্য এই ধর্মের অপব্যাবহার করে মানুষদেরকে ওয়াজ মাহফিলে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তাদের ভড়কে দেয়া তাইতো? অতএব, কোরানকে এরা ধর্ম রক্ষা বা ধর্মীয় অনুভুতির নামে নিজ নিজ স্বার্থ আর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এই মাওলানা মুফতিরা ব্যাবহার করছেন। ধর্মের রক্ষক যখন হয়ে যায় ভক্ষক তখন সেই মানুষ তার ধর্ম আর কোরানের অবমাননা করে নিজেদের জমজমাট ব্যাবসা ফেঁদে বসে। এরা ভাল করেই জানেন বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষদের ধর্মের দোহাই দিয়ে খুব সহজেই ভড়কে দেয়া যায় আর অমুসলিম সম্প্রদায়ের উপরে আঘাত হানা যায়। সম্পত্তি দখলে আনা যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর ক্ষমতার লোভে এই ধর্মকে সুনিপুণ ভাবে এরাই একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ পরায়ণ করে তুলছে দিনের পর দিন। এই সুবিধাবাদী আর সুযোগ সন্ধানী মুফতি মাওলানারা আপনারা ধর্ম নিয়ে পাক্কা ব্যাবসা করেন। মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করে উস্কানিমূলক কথা বলে মানুষদের একে অপরের শত্রু করেন। আপনারা হলেন ইসলামের প্রধান শত্রু/ আপনারাই হলেন কোরানে উল্লেখিত ইবলিশ শয়তান।
ধর্মীয় আলোচনার একটা ভরা মজলিসে অমুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে অসভ্য, অশ্রাব্য গালাগালি দিচ্ছেন, মাইকে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। মানুষকে হত্যা করছেন। একবার ও চিন্তা করেন না যারা অন্য ধর্মীয় মানুষ ওদের কেমন লাগে? ওরাও তো মানুষ। ওরাও তো আপনাদের মতই রক্ত মাংসে গড়া সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টি। যদি মেনেই থাকেন মানুষকে স্বয়ং আল্লাহ্তালা সৃষ্টি করেছেন তাহলে উনার সৃষ্টি কে এভাবে লাঞ্ছিত করে তো স্বয়ং সৃষ্টি কর্তাকেই লাঞ্ছিত করছেন। যদি তাই করে থাকেন তাহলে,আল্লাহ্তালা যে কোরআন কে নাজিল করেছেন সেই কোরানকেও আপনারা অবমাননা করছেন?
আপনারা কি ধরনের মুসলিম? কে বলে আপনারা মুসলিম? ধর্মের শিক্ষা নামে ধর্ম রক্ষার নামে আপনারা ধর্মের অপব্যাবহার করছেন। সবার আগে তো আপনাদের বিচার হয়া উচিৎ। আপনাদের দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তি হয়া উচিৎ। আপনাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের বাবস্থা করা উচিৎ। আপনারা কোন অধিকারে নাস্তিকদের কে নাস্তিক বলেন? আপনারাই তো হচ্ছেন সবচেয়ে বড় নাস্তিক। আপনারাই তো ইসলামের আসল শত্রু। আপনাদের মতো শয়তান এই পৃথিবীতে যতদিন থাকবে ততদিন ইসলামকে মানুষ অশান্তির ধর্ম বলেই জানবে। আপনারা নিজেরাই কোরআন অবমাননা করছেন। নিজেরাই দেশের শান্তি নষ্ট করছেন।
একটা বিষয় আপনারা সকলেই ভুলে যান। সকল ধর্মের প্রাথমিক শিক্ষাগুলা কিন্তু এক। খেয়াল করে দেখবেন, প্রত্যেক ধর্মই সদাচার, সত্য বলা, পিতামাতাকে সম্মান করা, সৎ পথে চলা, ন্যায়ের পক্ষে থাকা, ,অন্যায় না করা, মিথ্যা না বলা, ব্যাভিচার না করা, পাপ না করা ইত্যাদি এই বিষয় গুলোর কথাই বলে। আর আপনারাও যদি সেটাই খুঁজে পান আর তাই যদি হয়, তাহলে ধর্মের সঙ্গে সংঘর্ষটা আমাদের কোথায়? প্রত্যেক ধর্ম অবশ্যই একটি ব্যক্তিগত আচার, যার ইচ্ছা পালন করবেন যার ইচ্ছা পালন করবেন না , পুরোটাই সম্পূর্ণ ব্যক্তির উপর নির্ভর করে, সে কি করবে। এবং এটা সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ব্যাপার। বিশ্বাস আসে অন্তর থেকে। সেই বিশ্বাসটা আপনার বা আমার জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার না। নিজেদের অন্যায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যে অন্যায় আপনারা করছেন তা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং দুঃখজনক। অন্য ধর্মীয় মানুষদের হৃদয় ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন। রাতের ঘুমটুকু কেড়ে নিচ্ছেন ।কষ্টে আর যন্ত্রনায় অসহায় মানুষগুলো গলা দিয়ে খাবারটুকু নামাতে পারছে না। নিজের দেশে নিরাপত্তাহিন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে শুধু মাত্র আপনাদের কারনে।
কখন কি ভেবে দেখেছেন যা করছেন এতে করে নিজেদের ধর্মকে কত ছোটো করে ফেলছেন? ধর্ম কি এতই ছোটো, যে কারো করা উক্তি বা কতুক্তিতে ধর্মের এততুকু মান নষ্ট হয়? আর ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে অন্যের ধর্মকে পায়ের নিচে দলতে হয়? ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে হয়? এ মহা পাপ। এ অন্যায়। এ অবিচার। ওরাও মানুষ ওদেরও যন্ত্রণা আছে। ওদের মন ভেঙ্গে মসজিদ ভাঙ্গছেন। ধর্মের রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে যাচ্ছেন দিনে দিনে। তাই দিন থাকতে দ্বীনের সাধন জেনে রাখেন। সময় গেলে কিন্তু আর সাধন হবে না।