বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর তথা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ-এর বিষয়টা যদিও খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করছিলাম, কিন্তু এ বিষয়ে কিছু লেখা হয়ে ওঠেনি। সত্যি বলতে কি, মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে ছিল গত দুই-দিন। বারবার ভাবছিলাম, এমন ঘটনা তো আমাদের কাছের আত্মীয়-বন্ধু-বান্ধব-দের সাথেও হতে পারতো(!), এভাবে আসলে কল্পনা করতেও ভয় হয়।
যারা বিগত কয়েকদিন ধরে সংবাদ পত্রিকা পড়েছেন বা নাসিরনগরের স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনেছেন, তাদের কমবেশি সবাই জানেন ওই দিন কি ঘটেছিলো এবং কেনো ঘটেছিলো, তাই এই বিষয়ে নতুন করে লিখছি না। তবে ঘটনার সারসংক্ষেপ এভাবে টানা যায়, যখন আমরা সবাই ইংল্যান্ড-এর বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করছিলাম, তখন এক তান্ডব-ঝড় বয়ে যায় নাসিরনগরের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর। আহলে সুন্নাত-নামের সংগঠন একটি সমাবেশ আয়োজন করে ফেসবুকে এক হিন্দু যুবকের ইসলাম অবমাননাকারী এক পোস্টের প্রতিবাদ করার জন্য এবং ওই সমাবেশ-এরই এক পর্যায়ে সবাই বক্তাদের ভাষণ শুনে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে যায় এবং ওই সমাবেশ থেকেই সংগঠনের সদস্যবৃন্দ, এলাকার মাদ্রাসার ছাত্র সহ এলাকার কয়েকশ’ মুসলমান মুমিন প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালায় প্রায় ৪-৫টি মন্দির ও কমপক্ষে ১৫০ হিন্দু বাড়িতে। হামলার সময় লুটপাটও করা হয় হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরগুলোতে।
তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো যে, ওই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন ও স্থানীয় থাকার ওসি আবদুল কাদের। এবং নির্যাতিত হিন্দুদের অনেকেই এও দাবী করেন যে, উক্ত দুই সহ ওই সমাবেশে সকল বক্তার বক্তব্যই বেশ উস্কানিমূলক ছিলো।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের ধর্মীয় উস্কানিমূলক কোন সমাবেশে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অংশ নেওয়ার কিংবা তাতে উস্কানীমূলক বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার কি আদৌ তাঁদের আছে? তাছাড়া পরিস্থিতি যখন বেসামাল হয়ে যাচ্ছিলো, তখন পরিস্থিতি শান্ত করার দায়িত্বও কি সেই সরকারী দুই কর্মকর্তার ওপর বর্তায় না?
অবশ্যই, প্রশাসনের উপস্থিতিতে ঝলমলে দিনের আলোতে এধরনের ঘটনা ঘটেছে। এবং সকল ক্ষয়ক্ষতির দায়দায়িত্ব ও প্রশাসন তথা সরকারের ওপরই বর্তায়, যেহেতু ওই এলাকার বড়ো পদবীর সরকারী দুই কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতো বড়ো ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রায় ৩ দিন পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রানীসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক। তবে হাস্যকর হলেও সত্যি, তাঁর অভিযোগ মিডিয়ার বিরুদ্ধে। তাঁর ভাষ্যমতে মিডিয়াই নাকি পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করে তুলেছে, তেমন কিছু নাকি ঘটেইনি ওইদিন। সবাইকে এলাকা ঘুরে দেখে আসার প্রস্তাবও দেন তিনি। এমন হাস্যকর বক্তব্য আমি খুব কমই শুনেছি। মন্ত্রী সাহেবের বক্তব্য শুনে আমার বার বার মনে পড়ছে ৫ই মে’র হেফাজতে ইসলামের কথা, তারা দাবী করেছিলো লক্ষ লক্ষ সদস্যদের নাকি পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলে এবং সব লাশ নাকি গুম করে ফেলে এক রাতে। হেফাজতের এই বক্তব্য আর মৎস্য মন্ত্রীর এই তেমন কিছু না ঘটার বক্তব্যও এক ধরনের, হাস্যকর বিষয়!
সরকারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর এধরনের বড়ো নাশকতা চালানো ও পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা না করা ও পরবর্তীতে সংসদ সদস্যের ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’-র মতো ঘটনা আসলেই অপ্রত্যাশিত। এবং ঘটনার পর যথেষ্ট সময় এবং বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তেমন কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় দেশের হিন্দুদের প্রতি সরকারের এক ধরনের অবহেলার প্রকাশই পাওয়া যায়। যদিও বিষয়টি নতুন কিছু নয়, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা তারও আগে থেকেই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, অন্যায় অবিচার ও সরকারের অবহেলার নজির অনেক রয়েছে।
তবে মাননীয় সরাকারের প্রতি আমার একটি প্রশ্ন, আপনারা কি চান, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সবাই এক এক করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাক আর তারপর আপনারা সবাই মিলে শতভাগ খাঁটি মুসলমান ডিজিটাল দেশের আত্মপ্রকাশ করতে? আর না চাইলে এই অসহায় গোষ্ঠীর প্রতি কেন আপনাদের এতো অবহেলা, কেনো আপনারা এতোদিন ক্ষমতায় থাকার পরও সংখ্যালঘুদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে অক্ষম?
স্বাধীনতার জন্য তো হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ সবাই লড়েছিলেন, প্রাণও দিয়েছিলেন। এমনকি এঁরাই সবথেকে বেশি নির্যাতিত হয়েছিলেন। তারপরও তাঁদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি। আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এসে যদি সংখ্যালঘুদের চোখে মুখে নির্যাতিত হওয়ার ভয় দেখা যায়, তাহলে এর থেকে বেশি লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। এই ব্যর্থতার দায় নেওয়ার জন্য যোদ্ধারা প্রাণ দেননি!