বাবারে ভাঙ্গিস না, ‘কেমনে বাঁচুম আমরা? পুলাপান নিয়া ক্যামনে বাঁচুম?
এ এক অসহায় হতদরিদ্র বাংলা মায়ের সন্তানের আহাজারি। হোক সে হিন্দু অবুও এই বাংলার মাটি তারও। যে মুখটা ছেলে সমতুল্য তোমাদের বাবা বলে সম্বোধন করে দুখানা হাত জোড় করে কান্নায় ভেঙ্গে পরেছিল, ওদের সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছ। এত নির্দয় আর অমানবিক তোমরা? কেমন করে পারো? পরিবার থেকে কি শেখো তোমরা? কেমন পরিবারেই বা জন্ম নাও তোমরা? ক্ষমতাই কি সব? মানুষকে কি মানুষ মনে হয় না? আর তাই এই ক্ষমতার বর্বর অপব্যাবহার?
যে দেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে একটি বীরের জাতি হয়ে আত্ম প্রকাশ করেছে সেই দেশের একই মায়ের সন্তানদের ধর্মের নামে বিভাজিত করে বাংলা মায়ের বুক চিরে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন? বাংলা মায়ের কাছে তো সকল সন্তানের সমান সমান অধিকার। এই দেশ তো আমারও। যদি আমার জন্মভুমি আমাকে তাঁর বুক থেকে আলাদা না করেন, তাহলে আপনারা কোন অধিকারে আমারই মায়ের বুক থেকে তাঁর সন্তানদের আলাদা করেন? ধর্ম আর অধর্মের পার্থক্য কি আদৌ আপনারা বোঝেন? অন্যের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, ওদের মেরে কেটে সর্বস্বান্ত করে আপনারা জায়নামাজের উপরে দাড়িয়ে আল্লাহ্র নিকট সেজদায় নুয়ে পড়েন? এই নামাজ কি আপনাদের কবুল হয়? আল্লাহ্ কি তা গ্রহণ করেন? স্মরণ করিয়ে দেই, এই পাপ কিন্তু নিজের বাপকেও ছাড়ে না। মৃত্যুর আগেই এই পাপের শাস্তি ভোগ করে কাফনের কাপড় জড়িয়ে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচেই চাপা পড়বেন। কারমা কিন্তু অত্যন্ত ভয়াবহ আর নির্দয়। কর্মের ফল ভোগ করেই এই পৃথিবী ছাড়বেন।
বাংলাদেশের অমুসলিম সম্প্রদায়ের সকলকেই ছোটবেলা থেকেই মালাউনের সন্তান বলে ছিঃ ছিঃ করে নিন্দা করে করেই গেছেন আপনারা। অথচ আপনারা যারা মুসলমান সম্প্রদায়,আপনাদের কে বলি, নিজের পূর্বপুরুষ যে সনাতন ধর্মের ছিল এটা আপনারা প্রত্যেকটা মুসলমান কেন ভুলে যান? আপনারা সকলেই তো ধর্মান্তরিত মুসলমান। সকলের পারিবারিক নামের পদবী গুলো তারই প্রমাণ দেয়। অনেকে আবার সেটাকেও মুছে ফেলে নতুন পদবী যোগ করে ধর্মান্তরিতর অস্তিত্বটুকু মুছে ফেলেছেন। আপনাদের এই ভুলে থাকার চেষ্টাকে আপনারা ভুলে গেলেও ইতিহাস কিন্তু কিছুই ভোলে না।
এদেশে আপনাদের ভাষায়, একজন অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ে যায় মালাউন। ঠিক তেমনি আরেক দেশে আপনাদের চিন্তাধারার মুসলিম সম্প্রদায়কেও কিন্তু এই মালাউনই ভাবে। অতয়েব ফলাফল কি দাঁড়ায়? আমরা সবাই কিন্তু কোন না কোন দেশের মালাউন। কি গায়ে লাগলো কথাটা? মানতে চাইছেন না? শুনুন, আপনার মানা, না মানা দিয়ে কিচ্ছু আসে যায় না। এটাই সত্য। এক হিন্দু আর এক মুসলমানের মধ্যে গলায় তুলসীর মালা, পইতা, সিঁথির মাঝে লাল সিঁদুর, ছাড়া আর কি কোনো বাহ্যিক পরিবর্তন আছে? সবাই তো মানুষ। রক্ত মাংসে গড়া আপনার মতই মানুষ। আপনাদের মতই ওদের শরীরের গড়ন, আর ভালবাসায় ভরা একটা বিশাল মন। আপনারা যেমন ভালবাসার নজির স্থাপন করতে জানেন, বিশ্বাস করেন ওরাও পারে। আপনাদের মন যেমন বিশাল আর সেই মনে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে আপনারা যেমন অনেক মানুষকে জায়গা দিতে জানেন, বিশ্বাস করেন ওরাও জানে। মানুষের কষ্টে যেমন আপনাদের চোখের কোণ ছলছল করে ওঠে, অন্তর দুমড়ে মুচড়ে হাহাকার করে ওঠে, বিশ্বাস করেন ওদেরও করে।
যে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের আশায় আমরা এই বীরের জাতি স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমাদের দেশটা আজ বড়ই অসহায়। আজ ভাইয়ের পাশে ভাইয়ের কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে দাঁড়াবার বড়ই প্রয়োজন। আজ বাংলা মায়ের সন্তানদের একে অপরের পাশে দাঁড়াবার সময়। আমার সেই সোনার বাংলাদেশকে পারেন না আপনাদের ভালবাসা দিয়ে ফিরিয়ে দিতে? পারেন না সবাইকে বুকে জড়িয়ে নিতে? পারেন না একই মায়ের সন্তান হয়ে একতাবদ্ধ হয়ে সারা পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে? আমরা দেশ হিসেবে ছোটো হতে পারি কিন্তু জাতি হিসেবে অনেক, অনেক বড়। যে জাতি মায়ের ভাষার জন্য বুকে বন্দুকের গুলি ধারন করে হাসতে হাসতে মরেছিলো আর স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বুক চিরে পূর্ব পাকিস্তানকে তুলে এনে বাংলাদেশকে জন্ম দিয়েছিলো, আমি সেই জাতির বীরত্বকে সম্মান করি। একমাত্র আমরাই পেরেছিলাম, আমরাই পারি , এখনও পারি। বীরত্ব আমাদের রক্তে। ভালবাসা আমাদের ধর্মে।
যেদিন থেকে হিংসা, দ্বেষ, খুনাখুনি, মারামারির এই ধ্বংসযজ্ঞ করা বন্ধ করে মানুষকে মানুষ ভেবে বুকে জড়িয়ে ধরবেন, সেদিনই হবেন আপনি একজন প্রকৃত মুসলমান, হিন্ধু, বোদ্ধ, খ্রিস্টান। এই পরিবর্তন অন্যের থেকে আগে আশা না করে আগে নিজের থেকে হোক। শুরুটা নিজের কাছ থেকে হোক। যেদিন থেকে শুরু করবেন দেখবেন সকল ধর্ম শান্তির ধর্ম মনে হবে। সকল ধর্মকে একই মনে হবে। দেখবেন সকল ধর্ম শুধুমাত্র শান্তিরই কথা বলে। বিভাজন সৃষ্টি করে মানুষ। আর এই বিভাজনকে ত্যাগ করতে পারে কেবলমাত্র মানুষ। আগে মানবধর্মকে সবার উপরে স্থান দিন। দেখবেন তখন প্রত্যেক ধর্মই সকলের কাছে পবিত্র মনে হবে। ধর্মের জন্য মানুষ বাঁচে না। মানুষের জন্য মানুষ বাঁচে।