Atheist Chapter

বাংলাদেশে আদী বাসী প্রসঙ্গে

বাংলাদেশে আদিবাসী কারা? বাংলাদেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, খাসিয়া, ওরাও, ত্রিপুরা, খিয়াং, বম, চাকসহ ৪৫টি জাতিগোষ্ঠির বসবাস পাঁচশো বছরের বেশি নয়। বাঙালীরা তার চেয়ে ঢের বেশি শতাব্দীকাল ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। সেই হিসেবে তো বাঙালীরাই এখানকার আদিবাসী, তাই নয়?

যেহেতু আমরা অজ্ঞ এবং স্বার্থের খাতিরে মিথ্যাকে আশ্রয় করে থাকতে পছন্দ করি তাই ‘আদিবাসী’ কথাটাকে ‘কে আগে এসে বসবাস শুরু করেছে’ হিসেবে ধরে নিয়েছি। পৃথিবীতে কাদেরকে ‘আদিবাসী’ বলা হয় আগে সেটা ভাল করে জানুন। কোন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠি যারা সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদকে (যেমন পাহাড়, বন) লালন পালনসহ নিজেদের জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে, যারা রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনের চেয়ে নিজেদের গোত্রের আইনে নিজেদের অভ্যন্তরিন বিরোধ মেটায়, ব্যক্তি মালিকানার বাইরে জমির মালিক মোড়ল ও গোত্রের উপর বর্তায়, নিজেদের প্রাচীন আইনে গোন্ডিবদ্ধ রেখে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে- তাদেরকেই আন্তর্জাতিকভাবে ‘আদিবাসী’ বলা হয়ে থাকে। এখানে কে আগে এসে বসবাস করেছে তা বিবেচ্য নয়।

তবে ‘কে আগে থেকে এসে বাস করছে’- এই বিচারেও বাংলাদেশের বহু জায়গায় কথিত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিরা’ বাঙালীদের থেকে আগে বসবাস করছে। যখন মানুষ বাঘের ভয়ে, সাপের ভয়ে পা দিতো না তখন কারা পাহাড়কে, বনকে বাসযোগ্য করেছিল সেই ইতহাসও জানতে হবে। কাজেই বাঙালিরাই আদিবাসী- এরকম কুতর্ক আর ইতরামি করলে পাল্টা একটা ইতরামি প্রশ্ন করা যেতেই পারে- এই অঞ্চলে তো বাঙালীরা হাজার বছর ধরে বাস করে আসছে- তা ‘মুসলমান বাঙালীরা’ কবে থেকে এসে বসবাস করছে? বঙ্গের মুসলমানরা বর্হিরাগত বিদেশী মুসলমানদের সন্তান কিনা সেই বিতর্ক বহু পুরোনো। সবচেয়ে বড় কথা- এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক ‘মুসলমান বাঙালীদের’ ঐতিহাসিক কোন দলিল নেই- তারা কি বহিরাগত নাকি বাঙালী হিন্দুর ধর্মান্তরিত?

যাক, ইতরের সঙ্গে ইতরামি করলে তিক্ততাই বাড়বে। তারচেয়ে আসল কথাতেই ফিরি। বিশ্ব আদিবাসী দিবস প্রতিরোধের যে ডাক দেয়া হয়েছে, সেই ডাকের অর্থ হচ্ছে পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীদের জায়গাজমি দখলের যে ধারাবাহিকতা চলছে সেটা বজায় রাখা। কারণ সংবিধানে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি দিলে পাহাড়ে সেটেলারদের অনুপ্রবেশ ঠেকাবে। এসব কারণেই আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি’ বলে ডাকা হচ্ছে। শেখ হাসিনা খালেদা জিয়া দুজনই এক সময় আদিবাসী হিসেবে যাদের পরিচয় স্বীকার করতেন- এখন তাদেরকে উপজাতি, নৃগোষ্ঠি নামে ডাকেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির আধিপত্য জারি রাখার জন্য। দুদলই পাহাড়ে সেটেলার বাঙালীদের ভোট পাকা করতে চায়।

সাধারণভাবে আরো একটি প্রচারণা হলো, পাহাড়ে অবাঙালী ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না কিংবা সেখানে জমির মালিকানা অবাঙালীদের ছাড়া আর কারোর নেই। খুব স্বাভাবিক এ ধরণের প্রচারণা শুনলে যে কেউ ক্ষুব্ধ হবেন। সারাদেশে আদিবাসীরা যেখানে খুশি বাস করতে পারলে, জমির মালিক হতে পারলে পাহাড়ে বাঙালীদের সেই অধিকার থাকবে না কেন? আসলে এই প্রচারণা পাহাড়িদের প্রতি সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে দেয়ার জন্য। আসল সত্য হচ্ছে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক পার্বত্য এলাকাতে জমি কিনে বসবাস করতে পারবেন। যেটা পারবেন না- পাহাড়ীদের গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাঙালী পরিচয়ে ভূমিহীনদের এনে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়া। ‘সেটেলার বাঙালীরা’ কার কাছ থেকে জমি কিনেছে আদিবাসী গ্রামে? সেই জমির মালিক কি সরকার? ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি’ বলে ডাকলে পাহাড়ের জমি মালিকানায় আদিবাসীদের যে শত শত বছর ধরে গোত্র ভিত্তিক বিধান (আন্তর্জাতিকভাবে) সেটাকে স্বীকার করার আর কোন দায় থাকে না।

যেহেতু কাগজে কলমে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ বলতে কিছু নেই তাই আদিবাসীদের ভূমি আইন বাংলাদেশ সরকার মানতে বাধ্য নয়। পাহাড়ে জঙ্গলের মালিক সরকার বাহাদুর। সেখানে সরকার বাহাদুর যাকে খুশি থাকতে দিবে, যাকে খুশি উচ্ছেদ করবে…। ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি পাহাড় জঙ্গলের মালিক আদিবাসীদের উপর বর্তায়। আমাদের মহান সংবিধানে আদিবাসীদের কোন স্বীকৃতি নেই এ কারণেই। ৭২ সালের সংবিধান তাদেরকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছিলো। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে ‘বাঙালী’ হয়ে যেতে বলেছিলেন। উনাকে যদি পাকিস্তানীরা ‘পাঞ্জাবী’ হয়ে যেতে বলতেন উনি কি সেটা মেনে নিতেন? জিয়াউর রহমান, এরশাদ আমলে সেটেলার বাঙালী নামের হাজার হাজার অবৈধ অনুপ্রবেশকারীতে পাহাড়গুলোকে ভরিয়ে ফেলা হয়। বার বার অস্বীকার করা হয় তাদের সংবিধানিক স্বীকৃতি। সেনা বাহিনীর নির্মমতার জবাব দিতে শুরু হয় আদিবাসীদের সশস্ত্র লড়াই। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে আদিবাসীদের দাবি দাওয়া মেনে নেয়া হয়। কিন্তু এই চুক্তি ছিল বড় ধরণের তামাশা। আদিবাসীদের এখন ডাকা হচ্ছে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি’ নামে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী সংজ্ঞা অনুসারীরে পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমতলে বসবাসকৃত জনগোষ্ঠিদের জমি ও জীবন বৈচিত্র নিশ্চয়তা দেয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি ডাকলে আদিবাসীদের গোষ্ঠিবদ্ধ জমি মালিকানাকে অস্বীকার করে সেখানে সেটেলার দিয়ে ভরাট করা যাবে। যারা একদিন জনহীন জঙ্গল আর পাহাড়কে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলেছিল, তাদের জমির দলিল, খতিয়ান দাগ নম্বর চাওয়া এই রাষ্ট্রের এক বিরাট পরিহাস। বৃট্রিশ আমল, পাকিস্তান আমলেও আদিবাসীদের আদিবাসীই ডাকা হতো। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তারা এখন নিজ ভূমিতে পরবাসী। এই বাংলাদেশ আসলে ‘বাঙালী মুসলমানদের’। সমতলের ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর পাহাড়-জঙ্গলের জাতিগত সংখ্যালঘু নিপীড়ন দেখলে সেটাই স্পষ্ট হয়ে পড়ে…।

সৈয়দ সজীব আবেদ

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.

Most popular