Atheist Chapter

মাদ্রাসা বিষয়ক কিছু কথা

মুঘল আমলে ভারতবর্ষে ১২ লক্ষ মাদ্রাসা ছিল। এসব মাদ্রাসাতে আরবী ফারসী ভাষাতে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করে মুসলমানরা শিক্ষিত হত। কাজেই মুসলমানরা শিক্ষায় দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল ইতিহাসের এই ভাষ্য সঠিক নয়। তারা যেটা ছিল, যুগোপযোগী শিক্ষা থেকে পিছিয়ে ছিল। ইংরেজ আমলে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য আলীয়া মাদ্রাসা গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এটাকে মুসলিমরা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে থাকে। ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত, সমাজ বিজ্ঞান ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে একত্রে পাঠ করিয়ে তাদেরকে ইসলামী খিলাফত, জিহাদ থেকে আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তা উপযোগী করে গড়ে তোলাই উদ্দেশ্য ছিল। মুঘল আমল শেষে ইংরেজদের পরাধীন ভারতবর্ষে যখন ইংরেজি শিক্ষা চালু হলো, শহরে গঞ্জে স্কুল খোলা হলো, সেখানে লেখাপড়া করেই ভারতবর্ষের পরাধীন মানুষ ‘দেশ’ সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ করে। তারা যে পরাধীন বিদেশী শক্তির কাছে এই বোধও ইংরেজদের খোলা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে বুঝতে শেখে। এসব স্কুলে মূলত হিন্দুরাই লেখাপড়া করে নিজেদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে। স্বদেশীকতা, স্বাধীনতার বিজ এসব শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে গড়ে উঠেছিল। কাজেই ভারতে স্কুল খোলাটা ইংরেজদের ষড়যন্ত্র নয়, বরং শাপে বর হয়েছিল। কোন ইতিহাস বিশ্লেষকই তাই বলেননি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলে ইংরেজরা ভারতীয়দের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু এই অভিযোগটা ঠিকই মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে আসে। তারা বলে থাকেন, আলীয়া মাদ্রাসা ছিল মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখার এক গভীর ষড়যন্ত্র!

খোদ আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইয়াকুব শরীফ বলেন, ‘মুসলমানরা ছিল বীরের জাতি, ইংরেজ বেনিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা, ও মর্যাদা হরণ করার জন্য পদে পদে যেসব ষড়যন্ত্র আরোপ করেছিল, আলিয়া মাদ্রাসা তারই একটি ফসল’ (আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, আবদুস সাত্তার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইতিহাস কোনভাবেই বলছে না মুসলমানদের পিছিয়ে রাখা হয়েছিল বা তাদেরকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল। মুসলমান সন্তানরা মাদ্রাসাতে গিয়ে ভর্তি হতো। উনিশ শতকে বদলে যাওয়া পৃথিবীতে বিগত শতাব্দির সামন্ত যুগের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠি স্রেফ বোঝা। ইংরেজ সরকার এদেশে একটি প্রসাশন দাঁড় করেছিল। থানা পুলিশ, বিচারালয় গড়ে তুলেছিল। সেখানে হাদিস কুরআন শেখা একজন ইসলামী শিক্ষিত লোক তো স্রেফ অশিক্ষিতের নামান্তর। তাই বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য গড়ে তোলা হয় আলীয়া মাদ্রাসা। ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যাতে আধুনিক চাকরি বাকরি জন্য প্রস্তুত হতে পারে সেই চিন্তা থেকেই আলীয়া মাদ্রাসার সূচনা। যদিও শুরুতে আলীয়া মাদ্রাসার হুজুররা ভারতবর্ষকে দারুল হার্ব মনে করতেন। বিশ্বাস করতেন জিহাদ করে ইংরেজ তাড়িয়ে ফের ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই রকম বিচ্ছিন্ন জিহাদের চেষ্টা আলীয়া মাদ্রাসার আলেমদের কাছ থেকে আসার পর ইংরেজ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। তারা আলীয়া মাদ্রাসার সিলেবাস থেকে ‘মিশকাত শরীফ’ ও ‘তাফসীরে বায়যাবী শরীফ’ বাতিল করে দেন। এসব পড়ে জিহাদ, জঙ্গিবাদে যাতে কেউ জড়াতে না পারে সেই লক্ষে মাদ্রাসা সেলেবাসকে সংস্কার করা হয়। খেয়াল করে দেখুন, আজকের সময় এসেও আমরা মাদ্রাসার সিলেবাস সংস্কারের দাবী করছি। ইংরেজরা দেশ ছেড়ে গেছে আজ ৭০ বছর। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার সিলেবাস থেকে জিহাদ, কতল, খিলাফত জাতীয় জঙ্গিবাদের মালমশলা বাতিল করার জন্য দাবী উঠছে। এই দাবীকে তখনকার মত আজও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলা হচ্ছে।

আলীয়া মাদ্রাসাকে ইংরেজ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হতেই কওমি মাদ্রাসার সূচনা ঘটে অবিভক্ত ভারতবর্ষে। ভারতের দেওবন্দে গঠিত হয় কওমি মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসাগুলোতে কি উৎপাদন হয় সেটা অত্যন্ত সহজ সরল ভাষাতে স্বীকার করেছেন মুফাসসীরে কুরআন আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী, ‘মাদ্রাসা শিক্ষিতদের কর্মজীবনের দায়িত্ব ডাক্তার হওয়া নয়, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হওয়া নয়, বৈজ্ঞানিক হওয়া নয়। মাদ্রাসা শিক্ষিতদের কর্মজীবনের দায়িত্ব জাতিকে পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ প্রদর্শনকারী একদল নায়েবে নবী তথা ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া তৈরি করা’ (দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিল ও দস্তারবন্দী ইসলামী সম্মেলনের বক্তৃতায়)। এখানে স্পষ্ট কওমি আর আলীয়া মাদ্রাসার প্রডাক্টস সম্পূর্ণ ভিন্ন। কওমি যেখানে কেবলি পরলৌকিক জীবনের জন্য, ইহজগতের ধানচাল যোগানের চিন্তা পরের মাথাতে রেখে নিজের পেট বাঁচানো সেখানে আলীয়া ইহজগতের সঙ্গে পরজগতের ভারসাম্য রেখে চলা। সেই অর্থে তাই আলীয়া মন্দের ভাল। কিন্তু সত্যিকারের আধুনিক মানুষ তৈরি করতে আলীয়া মাদ্রাসাও ব্যর্থ কারণ সেখানেও ১৪০০ বছর আগের রাজনীতি, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ, ঘৃণা আর অবিশ্বাসই পড়ানো হয়। যে কারণে মুসলমানদের মধ্যে প্রগতিশীল সেক্যুলার রাজনীতি সমাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষ বের হয়েছিল ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই। ইংরেজ আমলে কোলকাতা নিবাসী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুরা যে স্কুলগুলো খুলেছিল সেখানে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম ছাত্রও পড়ার সুযোগ পেতো। স্কুল তো আর কেবল হিন্দুদের জন্য খোলা হতো না। এসব স্কুল থেকেই কাজি মোতাহার হোসেন, আবদুল ওদুদদের মত আধুনিক বাঙালী মুসলিম সমাজের প্রথম জেনারেশনের সূচনা ঘটেছিল। দুই-একজন মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে আধুনিক সেক্যুলার মানসিকতার হয়ে বেড়ে উঠাকে বেতিক্রম হিসেবেই আমি বিবেচনা করে থাকি। যেমন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ…। দেশভাগ না হলে মুসলমানদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না, হিন্দুদের সঙ্গে তারা পেরে উঠবে না- দ্বিজাতি তত্ত্বের এই সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি মোতাহার হোসেন, কাজি আবদুল ওদুদুদের মত বুদ্ধিজীবীদের উন্মেষই ভুল প্রমাণিত করে। সে যুগে দরিদ্র সাধারণ মুসলমান ছেলেরা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিল হিন্দুদের গ্রামগঞ্জে স্কুল খোলার প্রচেষ্টার কারণেই। মাদ্রাসাতে ফারসী পড়ে গলা অব্দি জোব্বা লাগিয়ে নিজেদের হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে থাকার জন্য হিন্দুদেরই দায়ী করার মানসিকতা অযোগ্যদের অজুহাত মাত্র।

শতাব্দীকাল ব্যাপী মাদ্রাসা শিক্ষাই বরং মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার এক ষড়যন্ত্র! মুসলমানদের বাঁচাতে হলে অবশ্যই মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দিতে হবে। একই সঙ্গে জেনেরাল শিক্ষা থেকে ধর্মীয় চ্যাপ্টার বাদ দিতে হবে। এই কঠিন কাজটি আরো কঠিনতর করে তুলছেন সলিমুল্লাহ খানদের মত বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীরা যখন মাদ্রাসা শিক্ষার পক্ষে ওকালতি করেন, সেই শিক্ষাকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা বলে প্রচার করেন নিজেদের জাগতিক লাভ লালসা মেটানোর উদ্দেশ্যে তখন জাতির অধঃপতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কওমী মাদ্রাসা কতখানি ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস থেকে পরিচালিত হয় এটা বুঝতে সহজ হয় যখন কওমী মাদ্রাসার আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রফেট মুহাম্মদকে ধরা হয়! কথিত আছে মাওলানা কাসেম নানুতুভীকে হযরত মুহাম্মদ স্বপ্ন যোগে ভারতের দেওবন্দে লাঠির দাগ এঁকে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার হুকুম দেন। সেই মোতাবেক দেওবন্দে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এইরকম প্রতিষ্ঠান থেকে লম্বা দাড়িঅলা ছাগল ছাড়া আর কি উৎপাদন হতে পারে?

কওমি মাদ্রাসাকে বাংলাদেশ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমান করে দিয়েছে। এরপর জিহাদের উপর মাস্টার ডিগ্রী লাভ করে সরকারী চাকরিতে প্রবেশ করতে পারবে? দরিদ্র শ্রেনীর মানুষ মাদ্রাসাতে পড়াশোনা করে তাই তাদের মূল জীবনধারায় যোগ করার জন্য তাদের সনদকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে- সরকার প্রধানের এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। প্রাইমেরী শিক্ষাকে দরিদ্র শ্রেণীর কাছে পৌঁছে দিতে না পারার ব্যর্থতা নাকি ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি এটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা? দুটোই সরকারের ব্যর্থতার সূচক। দেশের জনগণের বিপুল একটা অংশ কওমি মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া করবে- এরচেয়ে আত্মঘাতি একটি দেশের জন্য আর কিছু হতে পারে না। জাতিকে আত্মঘাতি হতে সাহায্য করার জন্য বর্তমান সরকারের ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকবে…।

সৈয়দ সজীব আবেদ

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.

Most popular