Atheist Chapter

জেগে জেগে ঘুমানো জাতি

জাতিগতভাবে আমাদের নৈতিকতাবোধ কখনোই উচ্চমার্গীয় ছিলোনা বলেই বোধ করি। জাতির পিতার ক্ষেদোক্তি করে বলা “চোরের খনি” আজ সাড়ে সাত কোটি থেকে বেড়ে সাড়ে ষোলো কোটিতে পৌঁছেছে। এবং সবচাইতে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এটা সুধীসমাজের অনেকে অনুধাবন করতে পারলেও তাঁদের মধ্যে বিকার নেই বললেই চলে। ব্যাপারটা এমনই দাঁড়িয়েছে যে এখন ফেসবুকে রীতিমতো স্ট্যাটাস দিয়ে ঘুষ দিতে যায় লোকে! অর্থাৎ এসব ব্যাপারগুলোকে আমরা ডাল-ভাত খাওয়ার কিংবা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় একটা সেলফি তুলে আন্তর্জালে আপলোড করার পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছি!

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি আমাদের সমাজে বর্তমানে অনৈতিকতাকে আর আগের মত বাঁকা চোখে দেখা হয়না। বরং এটাকে ব্যক্তির “একস্ট্রা অর্ডিনারি” দিক বলে ভাবা হয়! কন্যার পিতারা আজকাল কন্যার জন্য বর খুঁজতে গিয়ে বর সরকারি চাকুরে শুনে “উপরি ইনকাম” এর হিসাবও নাকি নেন! দিন আসলেই বদলে যাচ্ছে!

পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়া নিয়ে কম কথা হচ্ছেনা। সবচাইতে মারাত্মক ও বিভীষিকাময় ব্যাপার হলো, অভিভাবকরা নাকি এখন নিজ দায়িত্বে কিশোর বয়সী সন্তানদেরকে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র চড়া মূল্যে কিনে দিচ্ছেন! অর্থাৎ শিশুকে যেমন ধরে ধরে হাঁটা শিখিয়েছিলেন তেমনি কিশোরকেও স্বহস্তে অনৈতিক পথের দিশা দেখিয়ে দিচ্ছেন এ অভিভাবকরা। সমস্যাটা রীতিমতো দুর্যোগের পর্যায়ে চলে আসে যখন স্বয়ং সরকার ব্যাপারটা দেখেও না দেখেন। বোঝাই যাচ্ছে এসবের পেছনে রাঘব বোয়ালরা জড়িত। প্রশ্ন ফাঁস রোধের জন্য জাফর ইকবাল স্যার কী করতে বাকি রেখেছেন?

এখানে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে চাইলেও বাধ্যতামূলক ডোনেশনের নামে টাকা নেয়া হয়। জমা রাখা অরিজিনাল সার্টিফিকেট তুলতে গেলে কেরাণীকে “চা খাওয়া বাবদ টাকা” দিতে হয়। ক্লাসে ঠিকঠাক পড়ানো হয়না কোচিং- এর ডিমান্ড তৈরি করতে। ছাত্র-ছাত্রীরা এসবের মধ্যে বড় হলে শিখবে কী?

অনৈতিকতার এ বৃক্ষ এরই মধ্যে মহীরুহের আকার ধারণ করেছে। সমাজের কোনো একটা অংশের দুর্নীতির গভীরে গেলে দেখা যায় সেটা আবার আরেকটা অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট! পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে মাথায় ভজঘট পাকিয়ে যায়!বোঝার সুবিধার্থে আমি পুলিশের ব্যাপারে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।

আমাদের গ্রামেরই এক লোক তার একমাত্র ছেলেকে অনেক কষ্টে অনার্স পাশ করিয়েছেন। পাশ করে বেড়িয়ে সে পুরো একটা বছর হন্যে হয়ে ঘুরলো চাকরির আশায়। কিন্তু চাকরি তো আজকাল যেনো সোনার নয়, হীরের হরিণ; সহসা ধরা দেবে কেনো?! এই এক বছরে সে যে অভিজ্ঞতা লাভ করলো তা হলো বাংলাদেশে চাকরি পেতে হলে খুঁটির জোর না হয় টাকার জোর থাকতেই হবে! আর প্রফেশন যদি একটু উঁচু লেভেলের হয় তাহলে শুধু খুঁটি কিংবা শুধু টাকায় হবেনা; উভয়ই লাগবে! যাহোক, এ অসামান্য জ্ঞান লাভ করে ছেলেটি মুষড়ে পড়লো। বাবার এতোদিনের কষ্টের প্রতিবিধানে সে কোনো রাস্তাই খুঁজে পেলোনা। বাধ্য হয়ে সে তার বাবার সাথে অনৈতিক ব্যাপারটা নিয়ে “ডিসকাস” করতে বসলো! সব শুনে অনন্যোপায় পিতা ধানী জমিটার বিনিময়ে হলেও টাকা জোগাড়ের নিশ্চয়তা দিলেন। নিশ্চয়তা পেয়ে ছেলে ফের ছোটে সোনার হরিণের পেছনে। একটা রফাও এর মধ্যে হয়ে যায়! কর কমিশনে বিস্তর লোক নেবে।

দশ লাখ জমা করলে চাকরি কনফার্ম; বিফলে মূল্য ফেরত! সরকারি চাকরি, সরকারি বেতন সাকুল্যে তেরো-চৌদ্দ হাজার হলেও কেবল উপরি হিসেবেই মাসে পঁচিশ-তিরিশ হাজার পকেটে ঢোকানো কোনো ব্যাপারই না! সন্দেহ নেই লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু বাবার ধানী জমির দাম কোনোমতেই সাড়ে চার লাখের উপরে ছিলোনা। ফলে এ অফারখানা গ্রহণ করা গেলো না! কিছুদিন পরে আসলো পুলিশে ঢোকার সুযোগ! টাকা লাগবে পাঁচ লাখ! বাবা ভাবলেন তাই সই! ধানী জমি সাড়ে চার আর সুদে পঞ্চাশ। ব্যস! চাকরি হয়ে গেলো! বাবা এটাকে ভাবলেন “ইনভেস্টমেন্ট” হিসেবে! অনেকটা পাঁচ লাখ ব্যবসাতে খাটিয়ে মাসে মাসে তার থেকে লাভ পাওয়ার মতো! কিন্তু পুলিশের চাকুরিতে বেতন সাকুল্যে নয়-দশ হাজার। এটা দিয়ে তো সংসারই ঠিকঠাক চলতে চায়না তার উপরে পঞ্চাশ হাজার টাকার ঋণের বোঝা আর ধানী জমি ফেরত আনার উচ্চাশা। এক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্ট “উঠাবার” জন্য ছেলের ব্যগ্রতা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না!

এখানে উঠানোটাই মূখ্য; কীভাবে উঠানো হলো তা গৌণ হয়ে যায়। একারণে নিরীহ কাউকে যদি বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় তবে তাই সই! যিনি বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন তারও একটা ক্ষেত্র আছে; তিনি আবার এই বিড়ম্বিত হবার যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি মস্তিষ্কে যত্নসহকারে লালন করবেন এবং তার আয়ত্বের ভিতর কোনো এক ভিকটিম আসার অপেক্ষায় থাকবেন! আসা মাত্রই সেই লালিত পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্নরূপে সৃষ্টি করে নিজের যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করবেন আরেকজনকে যন্ত্রণা দিয়ে! এভাবেই চলছে, হয়তো চলবেও।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দিন দিন প্রতিটা বাংলাদেশী এক একটা সাইকো হয়ে উঠছে! আঁতকে উঠবেন না যেনো! ঠিকঠাক জরিপ চালিয়ে দেখা যেতে পারে।

আমাদের দেশে মোটামুটি গোটা শতেক প্রিন্ট মিডিয়া ও গোটা চল্লিশেক ইলেকট্রনিক মিডিয়া দৈনিক এতোগুলো “রোমহর্ষক” ঘটনা প্রচার করলেও আশ্চর্য্যজনকভাবে খবরগুলো পড়ে আমাদের কারো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে না! আপনি একটু খেয়াল করুন; আমরা দৈনিক নিদেনপক্ষে ৫-১০ জন মানুষের অপঘাতে মৃত্যুর খবর শুনি বা পড়ি।
আর একটু মনযোগ দিন! আপনি কী অবলীলায় ৫-১০ জন মানুষের (হ্যাঁ! আমার-আপনার মতোই মানুষ! যার নিজস্ব একটা জগৎ আছে!) মৃত্যুর খবরটা পড়ে গেলেন! যে আপনি আপনার নিজের মৃত্যুর কথাটা চিন্তাও করতে পারেন না সেই আপনাকেই আপনার মতো অপর এক রক্ত-মাংসে গড়া মানুষের মৃত্যু (সেটা যত বীভৎসই হোক না কেনে) বিচলিত করতে পারছেনা! সামান্য মাত্রায় নিয়মিত বিষ গ্রহণে একসময় এমন হয় যে খোদ বিষধর গোখরার ছোবলেও আপনার কিছু হবে না; এটা পরীক্ষিত সত্য।আমাদের দশা হয়েছে তাই!

দৈনিক এতো এতো রোমহর্ষক খবর পড়তে পড়তে এখন এসব আমাদের গা সহা হয়ে গেছে! এখন লাশের সংখ্যাটা “ডাবল ফিগার” না হলে আমাদের চোখেই পড়ে না!

অপরদিকে আমরা যারা নিজেদের সুশীল বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি তারা আবার রগরগে ঘটনা ছাড়া ইস্যু পাই না; আর কোনো ইস্যু ছাড়া আমাদের পেটের ভাতও হজম হয়না! মিডিয়াগুলোও তাই! ওরা যার যার পত্রিকা চ্যানেলের কাটতি বাড়ানোর জন্য রগরগে খবর কামনা করে! আর কেউ কেউ তো “সাংবাদিকতা মহান পেশা” – এ আপ্তবাক্যটি ভুলে গিয়ে কারো স্বার্থেই হোক কিংবা দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই হোক সংবাদকে “মনের মাধুরী মিশিয়ে” প্রচার করতেই পছন্দ করেন!
আর এভাবেই আমাদের মানসিকতাটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে! দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আস্থা কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি কালীহাতীর ঘটনা তাতে আরেকটু গতি বাড়িয়েছে।

আমি আমার আশ-পাশেই অনেককে বলতে শুনেছি, “ধুর! বিএনপি কোনো দলই না! এরা কি বালের হরতাল ডাকে?! রাস্তায় তো দেখি জ্যাম লেগে যাচ্ছে! তার চাইতে জামাত-শিবিরের হরতালই ভালো! সব টাইট থাকে!”
সংবাদ পাঠককে বলতে শুনি, “সারাদেশে ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালন হয়েছে” -ভাবখানা এমন যে এতে ওনারা যার-পর-নাই ব্যথিত হয়েছেন!
অনেকে আবার হরতালকে “ছুটির দিন” বলে চালিয়ে দেয়া যায় বলে কিছুদিন পর পর হরতাল কামনা করেন!

এসব কিসের আলামত? আমরা কি “স্বার্থের” পেছনে ছুটতে ছুটতে “মনুষ্যত্ববোধই” হারিয়ে ফেলছি? আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের এ রাস্তা হতে ফিরে আসতে হবে; তা না হলে জাতি এই বিশ্বায়নের যুগে নিজেরা নিজেরা কামড়া-কামড়ি করেই ধ্বংস হয়ে যাবে- অচিরেই হয়তো পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বাংলাদেশীরা!

আসুন আমরা আবার সেই আগের সময়ে ফিরে যাই যখন প্রতিটা মানুষের অপঘাতে মৃত্যুকে “মানুষের” মৃত্যু বলে ভাবতাম; কেউ চোখের সামনে বিপদে পরতে দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। জেগে জেগে ঘুমানোর ভাব অনেক দেখানো হয়েছে।

পথ আপনার সামনে; বেছে নিন আপনার পছন্দ কোনটা- ত্যাগের পরিপূর্ণ শান্তি কিংবা স্বার্থের মেকি শান্তি।

সিদ্দিকুর রহমান

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.

Most popular