বেশ কয়েক মাস আগে উচ্চ আদালতের চত্বরে বিশ্ব-ন্যায়-বিচাররের প্রতীক গ্রীক দেবী থেমিসের “জাস্টিসিয়া” ভাস্কর্যটি স্থাপন করেন ভাস্কর-শিল্পী মৃণাল হক। এতোদিন ধরে বাংলাদেশ হাই কোর্টের সামনে ন্যায়-বিচারের প্রতীক জাস্টিয়ার ভাস্কর্যহীন শিল্পের যেই অপুর্ণতাটুকু ছিল, উচ্চ আদালতের সামনে জাস্টিসিয়া ভাস্কর্যটি স্থাপন করে শিল্পী মৃণাল হক যেন সেই অপুর্ণতাকে পুর্ণ করে দিয়েছিলেন। ডান হাতে তলোয়ার, বাম হাতে বিচার- মাপকাঠির দাঁড়িপাল্লা সজ্জিত ন্যায়-বিচারের প্রতীকী ভাস্কর্যটি উচ্চ আদালতের সামনে খুব শোভা পাচ্ছিল। হাই কোর্টের ভাবমুর্তি যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এদেশে এমন একটি ধর্মীয় গৌষ্টি আছে, তাদের জাস্টিয়ার ভাস্কর্যটি পছন্দ হলো না। তার কারণ কি? তার কারণ ভাস্কর্যটির পাশে রয়েছে ধর্মীয় গৌষ্টিটির জাতীয় ঈদগাহ মসজিদ। জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্যটি যেহেতু নারী-অবয়বের মুর্তি, সেহেতু জাতীয় ঈদগাহ মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লীদের ঈমান নষ্ট হতে পারে, এই যুক্তি দেখিয়ে এদশের হেফাজত ইসলাম নামক এক কট্টর মৌলবাদী ইসলামি সংগঠন ভাস্কর্যটি অপসারণ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবী জানিয়ে আসছে। সেই দাবীর সাথে একাত্ন প্রকাশ করেছে তথা কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী রাষ্ট্রের সরকার!
জাতীয় ঈদগাহ মসজিদের পাশে জাস্টিসিয়ার থেমিসের ভাস্কর্য থাকলে মুসল্লীদের ঠিক কোন যুক্তিতে ঈমান নষ্ট হয় তা আমার কোনোভাবেই বোধগম্য হয়না। ভাস্কর্যটি কি নামাজ পড়া অবস্থায় মুসল্লীদের পেছনে বাঁশ দিয়ে অবিরাম গুতা মারতে মারতে তাদের নামাজে ব্যাঘাত ঘটাবে? নাকি জাস্টিসিয়ার পাথরের ভাস্কর্য থেমিস খুব আবেদনময়ী হয়ে মুসল্লীদের সামনে তার বুকের কাপড় খুলে, নিতম্বের কাপড় খুলে মুসল্লীদের নামাজের মগ্নতা নষ্ট করবে? কোনটা? তা যদি না হয়, একটি ন্যায়-বিচারের প্রতীক পাথরের ভাস্কর্য কি করে মুসল্লীদের ঈমান নষ্ট করে? কি করে ইট-পাথরের গড়া ঈদগাহ মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করে?
হেফাজত ইসলামের দাবীতে সরকার হাই কোর্ট থেকে জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ায় এদেশের শুভবুদ্ধির মানুষগুলো মনে করছেন, এটা এদেশের প্রগতিশীলতার হার, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরাজয়। আমি তো বলি এটা রাষ্ট্র ও মুসলমানদের চরম নোংরামি আর অসভ্যতার পরিচয়। এই মুসলমানদের ঈমান ঠিক কতখানি ঠুনকো হলে একটি নারী জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্যে তাদের ঈমান নষ্ট হয়? ঈমান কতখানি হালকা হলে একটি পাথরের নারী-ভাস্কর্যের প্রতিকৃতি দেখে তারা শিশুদের মতো কান্নাকাটি করে ভাস্কর্যটি অপসারণের জন্য? ধর্মান্ধ মুসলমানরা জোরপূর্বক ভাস্কর্য অপসারণ করলে এটা কি আসলে প্রগতিশীলতার পরাজয় হয়? এই একবিংশ শতাব্দীতে এমন একটি অযৌক্তিক দাবী উঠা ও তো খুবি হাস্যকর, এবং সেই ধর্মীয় গৌষ্টির জন্য অনেকটা লজ্জাজনকও বটে। কিন্তু মুসলমানরা তা বুঝেনা। তারা তাদের চিন্তা-চেতনা ইসলাম, আল্লাহ ও নবীর কাছে এমনভাবে বন্ধক রেখেছে যে, তা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা তারা একবারও করেনা। মুসলমানরা আল্লাহ, ইসলাম ও বেহেস্তের আশাকে আগলে রাখতে গিয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের মানসিক বিকাশ হতে দেয় না। ঘুরে ফিরে অন্ধকারকে আগলে রাখে, অন্ধকার নিয়মকেই বুকে জড়িয়ে ঘুমায়।
আর বিচার বিভাগ চুপ থাকল কেন? বিচার বিভাগের মানুষগুলো কি মৌল্লাদের পা চাটা কুকুর? সকল আইনজীবি আর বিচারকের মধ্যে কি একজনও মেরুদণ্ড ওয়ালা মানুষ ছিল না ভাস্কর্য অপসারণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য? তারা কি সরকারের অঙ্গুলী হেলনে চলে? আইনজীবিরা কি জানে না জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য হল ন্যায়-বিচারের প্রতীক? যদি জেনে থাকেন তাহলে তারা কিভাবে এতো বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরব থাকল? ও হ্যাঁ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, এদেশে নাস্তিক ব্লগার আর স্পষ্টভাষী সৌদি আরবের হ্বজ ব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলা লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে আইনজীবী পাওয়া যায় না, কিন্তু মানবতা বিরোধী অপরাধী দেশদ্রোহী রাজাকারের পক্ষে শত শত আইনজীবী পাওয়া যায়। তাদের পেছনে শত শত আইনজীবীরা দাঁড়িয়ে যায়। একজন ধর্ষিতার পক্ষের চেয়ে একজন ধর্ষকের পক্ষে শত শত আইনজীবী এখানে লাইন দিয়ে দাঁড়ায়। একজন ক্ষতিগ্রস্ত নির্যাতিত ভিকটিমের পক্ষে যতটা না আইনজীবী পাওয়া যায়, তারচেয়ে শতগুণ বেশি আইনজীবী পাওয়া যায়, খুনীর পক্ষে, সন্ত্রাসের পক্ষে, ভুমিদুস্যদের পক্ষে। ন্যায় বিচারের প্রতীক জাস্টিসিয়াকে অপসারণ করলেও এদেশে অপদার্থ দায়িত্বহীন আইনজীবীরা কোনো মাথা ঘামায় না। এর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদের একটি শব্দও ব্যয় করেনা। অথচ এই আইনজীবীরাই জাস্টিসিয়ার বিচার ব্যবস্থাকে অবলম্বন করে জীবিকা চালায়, সংসার চালায়, বউ-বাচ্চা চালায়।
কট্টর মুসলমান-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, বিশ্বে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা নামে খ্যাত পাকিস্তান রাষ্ট্রটির হাইকোর্টেও লেডি অব জাস্টিসের ভাস্কর্যটি সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এদেশের মুসলমানদের মনে ইসলামিক অনুভুতি এতো প্রকট যে, তারা ৯০% মুসলমান রাষ্টের দোহায় দিয়ে হাই কোর্টের সামনে থেকে জাস্টিসিয়ার ভাষ্কর্যটি অপসারণ করিয়েই ছাড়ল! বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিল তারা মানসিকভাবে কতোটা ধর্ম-বিকারগ্রস্থ! এখানে রাষ্ট্র ও মুসলমানদের অসভ্যতার পরিচয় দারুনভাবে ফুটে উঠে। ভাস্কর শিল্পী মৃনাল হক, কেঁদে কেঁদে বার বার সাংবাদিকদের বলছেন, আমরা মৌলবাদের কাছে হেরে গেলাম। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীতে তিনিই সঠিক। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো হাইকোর্ট থেকে জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্য অপসারণ এটা প্রগতিশীলতার পরাজয় নয়, এটা রাষ্ট্র ও মুসল্লীদের অসভ্যতার পরিচয়। একটি ধর্মীয় গৌষ্টি কতখানি প্রভাবশালী হলে রাষ্ট্রের স্তম্ভ বিচার-বিভাগের জাস্টিসিয়া অপসারণ করার জন্য এই ইতরবিশেষ দাবী তোলে? আর সেই দেশের সরকারের কতোটা আদর্শ স্খলন হলে একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় গৌষ্টির নোংরা দাবী মেনে নেয়?