Atheist Chapter

কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল আর নেই

জসিম উদ্দিন মন্ডল নামের এক ভদ্রলোক আজ ভোরে মারা গেছেন। ৯৭ বছর বয়সে, দীর্ঘ অসুস্থতা নিয়ে। কি ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্রাউজারের ডানপাশে আরেকটা ট্যাব খুলে নামটা সার্চ করছেন?

লাগবে না, আপনাদের বিরক্তিমাখা খোঁজ কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের লাগবে না। খুঁজতে চাইলে ভালোবেসে খুঁজুন, সম্মান নিয়ে খুঁজুন। ১১ বছর বয়সে আপনার কথা, আপনাদের কথা, আমার কথা, আমাদের কথা- বলতে রাস্তায় নেমেছিলেন ট্রাক শ্রমিকদের আন্দোলনের সারথি হয়ে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটা আন্দোলনে, লড়াই-সংগ্রামে আওয়াজ তুলেছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন সৈনিক হিসেবে। মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের গাড়ি আসত, সেগুলো ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতেন। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে সব রকমের সাহায্য করেছেন।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছেন। ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠ। ১৯৪০-৪১ সালের কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে জ্যোতি বসু ঈশ্বরদী এসেছিলেন দু’তিন দিন থেকে একে একে সান্তাহার, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট প্রভৃতি এলাকায় রেল শ্রমিকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে। সে সময় শ্রমিকদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে তাকে এমএলএ প্রার্থী করা হলে জ্যোতি বসুর কাছে মুসলিম লীগের প্রার্থী হুমায়ুন কবির বিপুল ভোটে পরাজিত হন। জ্যোতি বসুর লাল ঝাণ্ডার পক্ষে মুসলিম লীগের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে সে সময় জসিম মণ্ডলের মাথা ফেটে যায়।

তাদের দেখে কলোনির লোকেরা ঠাট্টা করতেন- “এরা বলে ব্রিটিশ খেদাবে! এরা বলে ধনী উচ্ছেদ করবে!” কিন্তু লাল ঝাণ্ডা যে সাচ্চা লোকদের পার্টি এটাও তাঁরা বলতেন। তাঁরা জানতেন, এই পার্টিতে এমন সব সেলাক আছেন, যা অন্য কোনো পার্টিতে নেই।

৪৭ সালে মা বলেছিলেন- ‘বাবা জসিম! পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করিস না। পাকিস্তান হলে আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারব। ’ এ সময় তিনি মাকে বলেন- ‘মা! পাকিস্তান ধনী লোকের জন্য আমাদের জন্য না। আমি পাকিস্তানের পক্ষে থাকব না। ’

৪৯ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গ্রেফতার হলেন। জেলখানার ভেতরে নিম্নমানের খাবার দেয়া হয়, এ নিয়ে হাজতখানার ভেতরেই আন্দোলনে নামলেন। শাস্তি বেড়ে গেলো। এক মাস ঘানী টানার সাজা পেলেন। ঘানি টানানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে তাকে উলঙ্গ করে মাঘের শীতে ঠাণ্ডা পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্ব-পরিবারে অংশ নিয়েছেন। তার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় পাক বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন, ট্রেনিং-এর ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। ভারতের কলকাতা, দিল্লি, আগ্রা, শিয়ালদহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্থ, খাবার, পোশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন।

জীবনে ১৭টি বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। ব্রিটিশ আমলে ২ বছর, পাকিস্তান আমলে ১৩ বছর, স্বাধীনতার পর জিয়ার আমলে আরও ২ বছর। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় একলাই বীরের ভূমিকা পালন করেছিলেন। খুদবিরোধী আন্দোলন করেছেন মায়ের সাথে। জেলখানায় ঘানী-টানার বিরুদ্ধে লড়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাপড়া ওয়ার্ডে জেলখানায় সাত কমিউনিস্টের ওপর নির্বিচারের গুলি চালানো জেল সুপার বিলের সঙ্গে করেছেন আপোষহীন আচরণ।

তাঁর সারাটা জীবনই আন্দোলন, কোনদিন ঢাকামুখী রাজনীতি করেননি। বলেন-

“যে কথা আমরা ঢাকায় বলি, সেটি যদি গ্রামে না নিয়ে যাই, আমতলা, বাঁশতলা, কাঁঠালগাছের নিচে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, গ্রামের মানুষের কাছে না নিয়ে যাই, তাহলে কিভাবে হবে? সে জন্য ঢাকায় আসতে চাইনি। আমার কথা হলো, পার্টিকে গ্রামে নিতে হবে।”

তাঁর স্বপ্ন একটাই—সমাজতন্ত্র। বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্র হবেই।

শহুরে সুন্দর মানুষেরা জসিম উদ্দিন মণ্ডলের খোঁজ কোনদিন রাখেনি। তাঁর খোঁজ রেখেছে গ্রাম বাংলার নিপীড়িত মানুষেরা, যাদের জন্য তিনি লড়েছেন। শহরের মানুষদের যেদিন দরকার হবে সেদিন ঠিকই লাইব্রেরির তাক থেকে খুঁজে নেবে কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলকে।

সৈয়দ সানভী অনিক

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.

Most popular