খেলার মাঠে খেলোয়াররা সব সময় এক ধরনের উত্তেজনার মধ্যে থাকেন। প্রতিদ্বন্দিতার মধ্যে থাকেন। এগুলো সবই সহজ বোধগম্য বিষয়। এটি রকেট সায়েন্স নয় যে ব্যাপারগুলো বুঝতে পারাটা দুষ্কর। এইসব প্রতিদ্বন্দিতা কিংবা উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে খেলোয়ারদের মধ্যে অনাকাংখিত তর্কা-তর্কিও হতে পারে। সাধারণত খেলোয়ার রা এইসব ব্যাপার মাঠেই ভুলে যান এবং তাঁরা পরবর্তী ম্যাচের জন্য নিজেরা আবার তৈরী হন।
খুব সম্ভবত এমনই একটি উত্তেজনাকর মুহূর্ত থেকে আজকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের রংপুর রাইডার্স এবং চিটাগাং ভাইকিংস-এর মধ্যকার খেলাতে বাংলাদেশ দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তূজার সাথে বাংলাদেশ জাতীয় দলের নবাগত খেলোয়ার (পেইস বোলার) শুভাশীষ রায়ের খানিকটা বচসা হয়। খেলার মাঠের বিষয় খেলার মাঠেই দুই খেলোয়ার শেষ করে দিয়েছেন উপরন্তু ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বিন মর্তূজা তাঁর স্বভাব সুলভ আচরণ অনুযায়ী নিজেই ক্ষমা চেয়েছেন শুভাশীষ রায়ের কাছে এবং বড় হিসেবে তাঁর সবচাইতে সংযত আচরণ করবার কথা ছিলো সেটিও অকপটে বলেছেন। এটি মাশরাফির বৈশিষ্ঠ্য এবং তিনি যে প্রকৃত অর্থেই একজন অসাধারণ ব্যাক্তি তাঁরই বহিঃপ্রকাশ। ইনফ্যাক্ট, খেলা শেষে মাশরাফি-শুভাশীষ-তাসকিন-বিজয়দের আমরা আড্ডা দেবার ভিডিও-ও দেখেছি।
কিন্তু এই ঘটনা বাংলাদেশের কিছু “আবাল” দর্শক কেন মানবে? এইসব আবাল দর্শকরা খেলার সময়ে বসেই থাকে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা নিয়ে কিংবা একেবারে সভ্যতা বহির্ভূত চিন্তা ভাবনা নিয়ে। যেমন ধারা যাক সৌম্য সরকার খারাপ খেলছেন তো সেটির সমালোচনা এই কতিপয় আবাল দর্শক তাঁর খেলা নিয়ে করবেন না। তারা বসেই থাকবেন সৌম্য “হিন্দু কোটায়” দলে জায়গা পেয়েছেন এই জাতীয় নোংরা কথা বার্তা বলবার জন্য।
ঠিক একই ঘটনা লিটন দাসের বেলায় ঘটে কিংবা অতীতে তাপস বৈশ্যের বেলাতেও ঘটেছে। আসলে জাতি হিসেবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সাম্প্রদায়িক এবং নিজ গন্ডির বাইরে অন্য ধর্মের প্রতি এক অদ্ভুত বিদ্বেষ নিয়ে বসে থাকে মনের গহীনে। বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ হবার ফলে এর প্রকোপ আমরা আসলে সমাজের এই জাতীয় নানাবিধ ঘটনাগুলোতে প্রবলভাবে দেখতে পাই। যেমন আজকে মাশরাফির সাথে শুভাশীষ রায়ের দ্বন্দের ফলে মাশরাফি পোস্ট ম্যাচ যে ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করেছেন ( পড়ুন, মাশরাফির ফেসবুক ভিডিও কোন একটি আইডী থেকে ইউটিউবে আপ্লোড হয়েছে) সেখানে এক লোক মন্তব্যে লিখেছে-
“ওকে ধরে ওর নুনুর আগা কেটে দেওয়া হক। বিসিবির কাছে আবেদন।”
নোংরামোর সকল সীমা বা পরিসীমা এই মন্তব্যে ছাড়িয়ে গেছে। “মিস্টার এভরিথিং” ছদ্মনামে এই ব্যাক্তি ইউটিউবে এমন ভয়াবহ মন্তব্য করলেও এই ব্যাক্তি যে একজন মুসলমান সম্প্রদায় বা এই ধর্মীয় চিন্তাগত বোধ থেকে তার না বলা কথা উগরে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
শুভাশীষ হিন্দু এবং হিন্দুদের মুসলমানি হয়না মুসলমান ধর্মীয় পুরুষদের মত তাই মাশরাফির সাথে বচসার শাস্তি হিসেবে শুভাষীশের নুনু কেটে দিলেই উচিৎ শিক্ষা হবে বলে ধারনা এই মোমিন মুসলমান বান্দার।
এই মোমিন মুসলমান আর অন্যসব সাম্প্রদায়িক ইতরদের মতই মনে করেন সকল হিন্দুদের হয় জবাই করতে হবে না হলে তাদের পিটিয়ে, মেরে যেভাবেই হোক মুসলমান বানাতে হবে। এটাই আসলে আজকের বাংলাদেশের মৌলবাদীময় প্রকৃত চেহারা আর এই জাতীয় লোকের সংখ্যাই এই বাংলাদেশে আজকে অনেক। কেউবা লজ্জায় বলে না আবার কেউবা ছদ্ম নামে ঠিকি এইভাবে বলে বসে লাজ-লজ্জার বালাই না রেখে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ দর্শক ক্রিকেট খেলা দেখতে বসলে সৌম্য সরকার, লিটন দাশ, শুভাশীষ কিংবা শুভাগত হোম এই খেলোয়ারদের প্রতি অন্য রকম ভাবে তাঁদের চিন্তার প্যাটার্ন সাজায়। তামিম দিনের পর দিন রান না পেলে ট্রল হয়, হাসি ঠাট্টা হয় কিংবা নানাবিধ অপমানজনক কথা বার্তাও হয় কিন্তু ধর্মীয় নোংরামোর শিকার তাঁকে হতে হয়না। তামিমকে কখনো শুনতে হয়না যে তামিম “মুসলমান কোটায়” খেলে কিংবা তাঁর “নুনু কাটা” সে কারনে সে পারেনা। কিন্তু সৌম্য, লিটন দাস, শুভাশীষদের নিয়ে একটু কিছু হলেই তাদের উপর গালাগাল টা আর সেই ট্রল, ফান এগুলোর পর্যায়ে থাকেনা। ব্যাপারাটা হয়ে দাঁড়ায় ধর্মীয় নোংরামি আর সাম্প্রদায়িকতার যত্তসব কদর্য বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে।
আজকে মাশরাফীর সাথে শুভাশীষের যে মৃদু একটা মাঠ পর্যায়ে তর্কাতর্কি বা বচসা হোলো সেটা খেলার-ই অংশ। রাগবি খেলাতে তো ঘুষো-ঘুষি হয়, ফুটবল খেলাতে লাত্থা-লাত্থি হয়। কিন্তু খেলার পর খেলোয়াররা সেসব মনে রাখেন না।
কিন্তু আমাদের দেশে খেলার পর খেলোয়ার রা মনে না রাখলেও এইসব আবাল মুসলমান দর্শকরা তাঁদের ভেতরে জমিয়ে রাখা বিদ্বেষ প্রসুত মনোভাব, খুনে চিন্তা, নোংরা চিন্তা ঠিকি তাদের নিজস্ব মনোঃজগতের পর্যায়ে ড্র্যাগ করে এনে সেটা এইসব ঘটনার সাথে মিশিয়ে দেয়। যে কথা সে হয়ত খোলাখুলি শুভাশীষকে বলতে পারত না, সে কথা একটু চান্স পেয়ে উগরে দিলো মনের গহীনের কালো অন্ধকারের তার সকল সম্পদ থেকে, তার চিন্তার বিষাক্ত উপকরণগুলো থেকে।
আসলে আমরা ধীরে ধীরে এইভাবে সাম্প্রদায়িক একটা টোন কিংবা চিহ্ন এরই মধ্যে আমাদের নিজস্ব ভাবনার যায়গাতে স্থায়ী স্থাপনার মত তৈরী করে ফেলেছি। পুজো আসলে দল বল নিয়ে পুজো দেখতে যাবার সেই সৌন্দর্য্য কিংবা অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করবার ঐতিহ্য আর আমাদের দেশে নেই। এখন যা রয়েছে তা হচ্ছে কিভাবে অন্য ধর্মকে হেয় করা যায়, কিভাবে অন্য ধর্মের কিংবা ভিন্ন চিন্তার মানুষদের টেনে টেনে নীচে নামানো যায়।
একাত্তরে রাজাকার সাঈদী সকল হিন্দুদের মুসলমান করবার জন্য পিরোজপুরের পাড়েরহাটে ক্যাম্প বসিয়েছিলো পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে একাত্ন হয়ে। আর এই যুগে ঘরে ঘরে মুসলমানরা ওই সাঈদীর মতই মনোভাব নিয়ে এখন সামান্য বচসার ঘটনায় হিন্দুদের নুনু কেটে মুসলমান বানাবার চিন্তাতেই মগ্ন।
এই নুনু কাটার মোনোভাব-ই আসলে সত্যকারের আজকের মুসলমানদের মনোভাব, আর এটিই এই দেশের বাংলাদেশী মুসলমানদের চরিত্র।