উন্নয়নের গণতন্ত্র’ এই সময়ে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলোর একটি। জিনিসটা কী আসলে? প্রকৃতপক্ষে এটা গণতন্ত্রের সম্পূর্ন বিপরীত একটা জিনিস। এটাকে বিভিন্ন ইমেজের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়। একটা ইমেজের উদাহরণ দেই। আমাদের গ্রাম ও পাশ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলগুলির প্রশস্ত দেয়ালে ওই ইমেজটি আঁকা আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি এবং তার পাশে বড় অক্ষরে লেখা-‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’। এখানে ছবির চেয়ে কথাটা গুরুত্বপূর্ন, ইমেজের ওটাই মূল অংশ। জনগণের বা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নয়, এমনকি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশও নয়—শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে যা করতে চেয়েছিল, আওয়ামী লীগ তা করতে সক্ষম হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিলুপ্ত করে। বাংলাদেশে এখন আওয়ামী লীগ সরকার নামে যা আছে তার মধ্যে পার্টি, প্রশাসন, এবং স্বায়ত্ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেদ ঘুচে গেছে। এই সরকার তার সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পেরেছে সত্য, কিন্তু বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নামক ‘রাজনৈতিক দল’টিও বিলুপ্তির মুখে। আওয়ামী লীগের নাম, চিহ্ন ইত্যাদি অনেক শক্তিশালী হয়েছে সত্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ নামে যদি কখনো কোন জনগণের রাজনৈতিক দল থেকে থাকে, তা এখন আর অবশিষ্ট আছে কি না নিশ্চিত করে বলার উপায় নাই।” এখানে পারভেজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন যে পয়েন্টটি তুলে ধরতে পেরেছেন, সেটি হল, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পরিনতি। দৃশ্যত এই দীর্ঘ শাসনামলের সুযোগে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে—এটিই সাধারণ ধারণা। কিন্তু অরাজনৈতিক শক্তি-নির্ভর এক ব্যক্তির শাসন সত্যিকার অর্থে দল আওয়ামী লীগকেও শুকিয়ে মেরে ফেলছে। চিহ্ন শক্তিশালী হচ্ছে, কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে রাজনৈতিক দলতো বাঁচে না আসলে।
পারভেজ আরো লিখছেন—“দল, সরকার আর প্রশাসন মিলেমিশে যেটা আছে তা মূলত একটা অরাজনৈতিক প্রশাসন, যা এই প্রশাসনের সদস্য ও পোষ্যদের কাছে আজাজিল ফেরেশতা ও দেশের বাকি মানুষের কাছে সাক্ষাৎ ইবলিশ শয়তান। এই সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করলেও মূলত তা ঐ তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরই ধারাবাহিকতা। জনগণ নয় বরং অরাজনৈতিক প্রাশাসনিক কাঠামোই যার ক্ষমতার উৎস। গোলাম আযম নব্বইয়ের শুরুতে যে ফেরেশতা নিয়ে এসেছিলেন, তাই বড় হয়ে এখন বাংলাদেশ সরকারে পরিণত হয়েছে। এটাকে গোটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই জামায়াতিকরণ বলা যায়। এটাই নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের চূড়ান্ত পরিণতি।”
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিপদজনক নিঃসন্দেহে। তবে ভবিষ্যতে এরচেয়ে আরো অনেক বড় এক বিপদের শংকা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরছে। সবকিছুকে একটা হরর ছবির স্ক্রীপ্টের সাথে তুলনা করা যায়—নানান ঘটনা ও ঘনঘটার মধ্য দিয়ে যা চূড়ান্ত বাজে পরিনতির দিকে এগিয়ে চলছে। কিন্তু ভাল সমাধান আসতে পারে কোন পথে? এই মুহূর্তে একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা পাশ কাটিয়ে এই অন্ধকার যাত্রা থেকে ফিরে আসার আর কোনও পথ নেই। পারভেজ তাই প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে হলেও পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গড়াকে জরুরী মনে করছেন। কিন্তু পাশাপাশি সেই নিরপেক্ষ সরকার অরাজনৈতিক হলে সেই একই পুরোনো বিপদের আবর্ত থেকে যাবে—এই মত জানিয়ে পারভেজ নির্বাচনকালীন একটি রাজনৈতিক সরকারের ধারণা গড়ে তোলা এবং সকলে মিলে চাপ দিয়ে সরকারকে সেটি মেনে নিতে বাধ্য করানোর মধ্য দিয়ে এই বিপদ থেকে উত্তরনের সম্ভাবনা দেখছেন।
পারভেজ শেষ করছেন এই বলে—“আওয়ামী লীগ নামে রাজনৈতিক দলটির সামান্য অংশও যদি এখনো অবশিষ্ট থেকে থাকে, তবে তারা অবশ্যই অন্যান্য দলগুলোর সাথে আপোস করে এই ধরণের একটি ব্যবস্থা মেনে নেবেন। আর যদি সরকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ভিন্ন কোন অস্তিত্ব আর অবশিষ্ট না থেকে থাকে, তবে এই সরকারের পতনের সাথে সাথে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটিরও বিলুপ্তি ঘটবে।”
অফটপিক: বাকশাল গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বলেছিলেন—আপনিতো শান্তিপূর্নভাবে আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর কোনও পথ রাখলেন না।