বাঙালীর সব ত্যাগ গরুতেই সীমাবদ্ধ কিনা এটি একটি কোটি টাকার প্রশ্ন। মুসলমানদের রীতিনীতি- রিচুয়াল, কার্য পরিধি এগুলো নিয়ে বললেই আসলে ধর্মানূভূতির খড়গ হস্তে পড়তে হয় বলে ঠিক কোণ পরিধি নিয়ে লিখব সেটাই ভাবি। যাই হোক, কোরবানি আসলেই যেভাবে দেশে পশুকে জবাই করা হয় দেখেই মনে হয় এক এক নির্মম হত্যার প্রতিযোগিতা। হয়ত অনেকেই প্রশ্ন করবেন যে সারা বছরওতো পশু জবাই হয়, আমরা মুরগী খাই, খাসি খাই, গরু খাই সেগুলোও হত্যা। কথা সত্য। কিন্তু ধর্মের নামে যখন এক লাইনে এক কাতারে দাঁড়িয়ে হত্যার উৎসব হয় তখন খানিকটা ধমকে দাঁড়াতেই হয় বোধকরি।
তথাকথিত আল্লাহ ইব্রাহীমকে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানী করতে আদেশ দিয়েছিলেন স্বপ্নে, বাস্তবে নয়। মনোবিজ্ঞান, জ্যোতিশাস্ত্র, ধর্ম সহ সকল শাস্ত্র বলে স্বপ্ন হলো রূপক বিশেষ। আর ইব্রাহীমের বেলায় সে রূপকটির অর্থ ছিল তিনি আল্লাহ কে কতটা ভালবাসেন তা পরীক্ষা করা। তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছিলেন। পরীক্ষাটা ছিল শুধুমাত্র ইব্রাহীমের জন্য। তা যদি হয় তাহলে তার পদাংক অনুসরন করে বর্তমানে যারা কোরবানীর নামে নির্মম ও নৃশংসভাবে পশু জবাই করে তারা আল্লাহকে এর মাধ্যমে কি ধরনের ভালবাসা দেখায় ? এতে কি আদৌ আল্লাহর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়? বিশেষ করে সে পশুটা যদি হয় কোরবানীর আগের দিন হাট থেকে কেনা ?
আব্রাহামিক ধর্ম বলতে আমরা ইহুদী, খৃষ্টিয়ানিটী ও ইসলামকে বুঝি যাদের মূল উৎস হযরত ইব্রাহীম বা আব্রাহাম। ইব্রাহীমের কোরবানী যদি সার্বজনীন হতো তাহলে সর্বপ্রথমেই ইহুদীদের এর অনুসরন করার কথা। বাইবেলের পুরাতন নিয়মে আমরা দেখি মাঝে মাঝে মুসা নবী বা অন্যান্য নবী তার অনুসারীদের নিয়ে পশু কোরবানী বা বলি দিচ্ছেন কিন্তু সেটা বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে, যেমন- কোন রাজ্য জয় করার পর, অথবা কোন দুর্দিনের সময় দুর্দশা থেকে রক্ষা পেতে।
কিন্তু তারা চান্দ্র মাসের সেই নির্দিষ্ট দিনে কোরবানী করে না। অর্থাৎ ইব্রাহীমের বিষয়টা তারা একান্তভাবেই ব্যাক্তিগত হিসাবে বিবেচনা করে রেখেছে। এর পরে যীশু খৃষ্টের মাধ্যমে খৃষ্ট ধর্মের আবির্ভাব। তারাও কোন ইব্রাহীমের পদাংক অনুসরন করে বছরের নির্দিষ্ট দিনে কোরবানী উদযাপন করে না। অথচ এর পরের ধর্ম ইসলামে এসে সেই কোরবানীটাকে একটা প্রথা হিসাবে মোহাম্মদ চালু করে দিলেন যা ইব্রাহীম থেকে উদ্ভুত হলেও স্বয়ং ইব্রাহীম নিজেই কিন্তু পরবর্তীতে আর প্রথা হিসাবে সেটা পালন করে যান নি বা তা পালন করার জন্য বলে যান নি। যে কারনেই তার অনুসারী ইহুদীরা এটা প্রথা হিসাবে প্রতি বছর পালন করত না। খৃষ্টানরাও পালন করে নি।তাই আরজ আলী মাতব্বরের প্রশ্ন- তাহলে কোরবানীর ধর্মীয় ভিত্তি বা বৈধতা কি ?
আরও মজার কথা যেটা আরজ আলী মাতুব্বর বলেছেন তা হলো – আল্লাহ ইব্রাহীমকে পরীক্ষা করতে গিয়ে শুধু নিজের সবচাইতে প্রিয় জিনিসের কোরবানী দিতেই বলেন নি, তাকে ভীষণ অগ্নি কুন্ডে পতিত হয়েও ইমানী পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তাহলে মানুষ কেন কোরবানী প্রথা পালনের মত নিজেদেরকে অগ্নি কুন্ডে নিক্ষেপ করে তাদের ইমানী পরীক্ষা দেয় না প্রতি বছর প্রথা হিসাবে ? তা ছাড়া, ইব্রাহীম তার সবচাইতে প্রিয় বস্তু তার পূত্রকে কোরবানী দিয়ে আল্লার প্রতি তার ভালবাসার পরিচয় দিয়েছিলেন , কিন্তু বর্তমানে যারা কোরবানী দেয় তাদের কাছে সব চাইতে প্রিয় বস্তু কি হাট থেকে কিনে আনা পশু?
তবে সব চাইতে মজার কথা যেটা বলেছেন তা হলো – কোরবানীতে পশুটির হয় আত্মত্যাগ আর কোরবানী দাতার হয় সামান্য স্বার্থ ত্যাগ। কারন পশুটি নিজেই কোরবানী হয়ে আত্মত্যাগ করে, যেখানে কোরবানী দাতার সামান্য কিছু অর্থ খরচ হয় মাত্র। খরচের একটা বড় অংশ উসুল হয়ে যায় কারন কোরবানী দাতা পশুটির মাংশ মজা করে উপভোগ করে। তাও আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে অর্থ আসে অবৈধ পন্থায়। এ ধরনের আত্মত্যাগে পশুটি বেহেস্তে যাবে কিনা সে প্রশ্নই আরজ আলী মাতুব্বর রেখেছেন। সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো – সৎ বা অসৎ যে পন্থায়ই অর্থ উপার্জন করে পশু ক্রয় করা হোক না কেন , তাদের আত্মত্যগে তারা কোথায় যাবে এ ব্যপারে কোন ব্যখ্যা কোথাও নেই। কিন্তু ব্যখ্যা থাকাটা জরুরী। তবে বেহেস্তে গবাদি পশুদের কোন স্থান আছে কি না তা কিন্তু কোথাও উল্লেখ নেই।
সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে কাউকে হত্যার উদ্দেশ্যে গলায় ছরি ধরাটাই মহা অন্যায়। কিন্তু বর্বর আরবদের দেশে এই ধরনের আইন-কানুনও ছিলোনা। চিন্তা করেন তো কাউকে হত্যার উদ্দেশে আপনি ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আবার যুক্তি হিসেবে বলছেন আপনি স্বপ্নে দেখছেন। কতটা বর্বর আর ভয়াবহ চিন্তাও করা যায় না।
মুসলমানদের এই কোরবানির সময়ে এমন গরু নিয়ে উল্লাস দেখে মনে হয় সব ত্যাগ আর সব আল্লাহর সন্তুষ্টির মূল নিয়ামক-ই হচ্ছে গরু জবাই করে দেয়া। আসলে মুসলমানদের এই কোড়বানি নিয়ে এত আদিখ্যেতা দেখে মনে হতেই পারে সব ত্যাগ বুঝি গরুতে।